ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: সীমানা বলতে বুঝায় কাগজে আঁকা কৃত্রিম নির্মাণ। এটি ওয়েস্টফালিয়ান রাজ্য ব্যবস্থার অধীনে তাদের স্বার্থ পূরণের জন্য প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে পঞ্চদশ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত উপনিবেশবাদের বাড়াবাড়ি, সেইসাথে পরবর্তী ঔপনিবেশিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা সীমানা ব্যবস্থাকে আরো বৈধ করা হয়েছে। এই ধরনের মনুষ্যসৃষ্ট কার্যক্রম শুধুমাত্র মানুষদেরকে ভাগ করেছে, তাদের ভ্রাতৃত্ববোধ, বিশ্বাস, সংস্কৃতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি করেছে। তবে বর্তমান সময়ে বিশ্বায়নের যুগে যেভাবে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে চাইছে এবং দখল করতে চাইছে, এ অবস্থায় সীমানার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা যায় না। অতীত ইতিহাসে গেলে দেখা যায় ক্ষমতার দাম্ভিকতায় মানুষ এক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে কতশত রেখা টেনে মানুষদেরকে আলাদা করে দিয়েছে।
সীমানা ভাগের উত্তম উদাহরণ দিতে হলে ১৯৪৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির কথাই বলা যায়, যে বিভক্তিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাঞ্জাব এবং বাংলার দুইটি সীমান্ত অঞ্চল। ভারত ও পাকিস্তান দুই নবগঠিত রাষ্ট্রের জনগণদের মাঝে সংস্কৃতি, ভাষা সবকিছুর পার্থক্যের ফলে দুই অঞ্চলের মানুষই ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। সাদাত হোসেন মান্টো তার লেখায়, বিশেষ করে তার লেখা গল্প টোবা টেক সিং-এ অন্যান্যদের মধ্যে পাঞ্জাবের পরিস্থিতির মর্মস্পর্শী বর্ণনা প্রদান করেন। সাহিত্য ও গণমাধ্যম এই সীমানা বিভক্তির ঘটনাগুলোকে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছে, যা এখনো আমাদের মধ্যে তীব্র আবেগ জাগিয়ে তুলে।
পাঞ্জাব এবং বাংলার পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল (এনইআর) বিভক্তির ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নেপাল, ভুটান, চীন এবং বাংলাদেশ দ্বারা পরিব্যাপ্ত চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর পরিচিত অংশটুকু ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে এনইআরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে অতীত ইতিহাসে, শতাব্দী প্রাচীন নদীপথ এবং রাস্তা, এনইআর এর মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-চীনের সাথে সংযুক্ত করেছিল। যদিও এর ভূ-রাজনৈতিক কোনও গুরুত্ব নেই, তবে ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।
এই এনইআর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে আন্তঃসংযোগের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। এটি ইতিহাসবিখ্যাত সিল্ক রুটের সৃষ্টি করেছিল। বিখ্যাত চীনা সন্ন্যাসী, হিউয়েন সাং, সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে পুষ্যভূতি সম্রাট হর্ষবর্ধন এবং শক্তিশালী কামরূপ রাজা কুমার ভাস্করবর্মণের দরবার থেকে বৌদ্ধধর্মগুলোকে চীনে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত অথচ বিপদজনক পথে ভ্রমণ করেছিলেন বলে তার গ্রন্থ থেকে জানা যায়। তিনি সম্ভবত দক্ষিণ সিল্ক রুটের কথাই বলেছিলেন। অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে ঔপনিবেশিক কর্মকর্তারা এবং জিন ব্যাপটিস্ট শেভালিয়ার, জন ম্যাকশ, ফ্রান্সিস বুকানান হ্যামিল্টন, আরবি পেম্বারটন এবং আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জির মতো দুঃসাহসিকরা এনইআরের পার্বত্য অঞ্চলগুলো ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে আহোম রাজা কমলেশ্বর সিংহ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আসাম, ভুটান এবং তিব্বতের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য ছিল মোট দুই লাখ ভারতীয় রুপি। রুপা, ঘোড়া থেকে শুরু করে, সোনা, কস্তুরি, শুটকি, লবণ, গরু এবং আরো বিভিন্ন পণ্য নিয়ে তখন বাণিজ্য হতো। ১৯৫০ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তিব্বত দখলের হাতে, সাদিয়া (বর্তমান আসাম) এবং রিমা (বর্তমান তিব্বত) উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের দ্বারা বাণিজ্য করতেই ব্যস্ত থাকত।
ভারত-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে অবস্থিত লংওয়া নামক গ্রামে কোন্যাক নাগারা বসবাস করে। তারা এখনো তাদের অতীত ইতিহাস এবং লোককাহিনী নিয়ে গর্ববোধ করে এবং যুদ্ধ ও শিকার অভিযানে তাদের বীরত্ব প্রকাশ করে। তাদের পৃথিবী এই লংওয়াতেই সীমাবদ্ধ।
তবে বর্তমান প্রজন্মের এটা বুঝা প্রয়োজন যে এনইআর দক্ষিণ-পশ্চিম চীন এবং দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শক্তিশালী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে। এই অঞ্চলগুলো চীন, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য উপত্যকাভিত্তিক সরকারের কেন্দ্রীভূত রাজনীতির পরিধি হিসেবেও কাজ করছে। ঔপনিবেশিকতার লোভ এবং সুবিধাবাদ, সেইসাথে উপনিবেশকরণের প্রয়োজনীয়তার ফলে ভারত ও মায়ানমারের নাগা উপজাতিগুলিকে একে অপরের থেকে পৃথক করা হয়েছে।
প্রশিক্ষিত সামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা সুরক্ষিত জাতি-রাষ্ট্র এবং এর সীমানাগুলির অলঙ্ঘনীয়তার উপর ওয়েস্টফালিয়ান মডেলের জোর দেওয়া সত্ত্বেও, ঐতিহাসিক স্মৃতি থেকে উদ্ভূত সমস্যা এবং স্থানীয় বা সাম্প্রদায়িক আকাঙ্ক্ষাগুলি এখনো প্রাথমিক অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে। চীন, ভারত এবং মায়ানমারের মতো বহু জাতিগত রাষ্ট্রে বিরোধ কমাতে যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা অনেক চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। গত অর্ধ শতাব্দী ধরে, রাষ্ট্রগুলো তাদের সীমানার উপর সামরিক উপায়েই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার পাশাপাশি, রাষ্ট্রগুলো তাদের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নয়নের জন্য কাজ করে চলেছে এবং চেষ্টা করছে তাদের জনগণদের যেকোন সহিংসতা থেকে দূরে রাখার। গত কয়েক বছরে, ভারতের এনইআরে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু চীন এবং মায়ানমারে আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ঔপনিবেশিকবাদীদের সৃষ্ট এই সীমানাবিভক্তি সময় এবং মানুষের সুন্দর অভিপ্রায় ও ভালো আচরণের সাথে সাথেই মিটে যাবে একদিন।
আইকেজে /