ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: ৬০ শতাংশ জনগণকে দারিদ্রসীমা থেকে বের করে আনার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে চীন। ২০২২ সালে শূন্য কোভিড নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির পতনের মতো নানা কারণে বিশ্বে চীনের মর্যাদা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তবে বিশ্বের ১৫টি জনবহুল উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে চীনে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি কমেছে। একটি কৃষিনির্ভর সমাজ থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে চীনের রূপান্তর কয়েক লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে।
চীনের কয়েক দশকের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭৪ কোটি ৮৫ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সাহায্য করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের দারিদ্র্যের হার ৬৬.৩ শতাংশ থেকে কমে ০.৩ এ এসে নেমেছে।
তবে চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তৃতীয় মেয়াদ শুরুর সাথে সাথে, রিয়েল এস্টেট সংকট, শূন্য কোভিড নীতি ইত্যাদি কারণে দেশ চরম অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে।
২০২২ সালে, চীনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সর্বনিম্ন।
গত শনিবার, সকালে দেশের শীর্ষ আইনসভা, ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (এনপিসি) এর বার্ষিক অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া সরকারি কাজের প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করেন।
২০২২ সালের জন্য চীনের জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ৫.৫ ধরা হয়েছে, যা ১৯৯১ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। অপরদিকে ২০২২ এর জন্য, চীনের ঘাটতি ও জিডিপির অনুপাত ২.৮ শতাংশ।
আবার চীন তার জিডিপি বৃদ্ধির হার হ্রাস হতে পারে চিন্তা করে তৃতীয় ত্রৈমাসিকের অর্থনৈতিক তথ্যের প্রকাশের তারিখ পিছিয়ে দিয়েছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ২০তম কংগ্রেসের সময়, পরিকল্পনা অনুযায়ী কোন তথ্য কেন প্রকাশ করা হয় নি, তার ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয় নি। জিডিপি বৃদ্ধির তথ্য ছাড়াও এতে মাসিক শিল্প উৎপাদন, শক্তি উৎপাদন, স্থায়ী সম্পদ বিনিয়োগ, সম্পত্তি বিনিয়োগ এবং বিক্রয়, খুচরা বিক্রয় এবং আবাসন মূল্যের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা ছিল। মূলত এসব তথ্য গোপন রাখার কারণ, এসব তথ্য শি জিনপিংয়ের অপারগতাকেই প্রকাশ করে দিবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, ২০২২ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি ৩.২ শতাংশ হতে পারে। কেন চীনের বৃদ্ধির হার কমেছে তার কারণগুলোও নিরূপণ করা হয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো শি জিনপিংয়ের শূন্য কোভিড নীতি, যার ফলে দেশের প্রধান শহর এবং শিল্প কেন্দ্রগুলোকে লকডাউনে থাকতে হয়েছিল। তাছাড়াও সাংহাইয়ে দীর্ঘায়িত লকডাউনও অর্থনৈতিক স্থবিরতার একটি কারণ।
চীনে সম্পত্তি সংকট, ডেভেলপারদের বিপর্যয়, তাদের ঋণ খেলাপি এবং বাড়ির দাম ও বিক্রয়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। সম্পত্তি শিল্পের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখানেও পড়েছে।
১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মাঝে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। চীনা ভোক্তারা এখন সতর্ক হয়েছে। খুচরা ব্যয় হ্রাস এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তাদের রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে।
প্রায় অনেক অনেক বছর পর চীনা অর্থনীতি অন্যান্য দেশের অর্থনীতির তুলনায় কম পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
২০১২ সালে শি যখন চীনের নেতৃত্বে আসেন, তখন চীন ছিল ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির এক দেশ। বছরে প্রায় ৭ শতাংশের গড় গতিতে প্রসারিত হওয়া চীনের অর্থনীতির আকার শি’এর প্রথম দুই মেয়াদে দ্বিগুণ গতিতে প্রসারিত হয়েছিল।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। ১৯৮৯ সালের পর, প্রথমবারের মতো চীন তার বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না। বেইজিং এর অর্থনৈতিক মন্থরতার জন্যে দেশজুড়ে আরোপিত কোভিড বিধিনিষেধই প্রধানত দায়ী।
এদিকে, চীনের কোভিড পরীক্ষার নীতি, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রায় ১.৫ শতাংশ ধাক্কা দিবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীন এখন দেশে কোভিড পরীক্ষার হার বাড়িয়েছে। শুধুমাত্র জনসম্মুখে যাওয়ার জন্য, অফিসে কিংবা স্কুলে প্রবেশের জন্য ৪৮ ঘন্টার ভেতর নিউক্লিক এসিড পরীক্ষার প্রয়োজন। অনুমান করা হচ্ছে যে, চীনের প্রধান শহরগুলোতে পরীক্ষা চালাতে বছরে প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ খরচ হতে পারে।
যেখানে বিশ্ব দুই বছরের ভেতরেই করোনা মোকাবেলা করে সেখান থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে চীন এখনো করোনার সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এতে চীনের জনগণের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
করোনাভাইরাসের পুনরুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য চীন সরকার শূন্য কোভিড নীতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে বিস্তীর্ণ এলাকায় লকডাউনের কারণে এটি নাগরিকদের মধ্যে ভীতি, ক্রোধ ও বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে।
জিনজিয়াং প্রদেশে অবস্থা এতটা খারাপ হয়েছিল যে নাগরিকেরা লকডাউন থাকাকালীন খাবারের জন্য প্রার্থনা করেছে। তিব্বতের রাজধানী লাসায় ৯০ দিনেরও বেশি বাড়িতে আবদ্ধ থাকার পর জনগণ এর প্রতিবাদ করে।
আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে, জিনজিয়াং প্রদেশে কঠোর লকডাউন আরোপের পর অনাহারে এবং চিকিৎসার অভাবে কিছু উইঘুরদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানালে স্থানীয় প্রতিনিধিরা জিনজিয়াংয়ের উত্তরাঞ্চলের ঘুলজা (ইইনিং) নামক গ্রাম থেকে ৬০০ জন উইঘুরকে আটক করে।
তাছাড়াও সারাবিশ্ব জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে চীনকে। এতে চীনের ব্যাপক সম্মানহানি হয়।
চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে জিনজিয়াংয়ে দীর্ঘদিন ধরে কুসংস্কার ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে উইঘুর প্রজাতি। বেইজিং অজুহাত দেখিয়ে অন্যায়ভাবে কঠোর পুলিশ নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেছে। তাছাড়াও চীনা কর্তৃপক্ষ উইঘুরদের স্বায়ত্তশাসন ও তাদের ধর্মীয় অভিব্যক্তির দাবিকে দমন করেছে বলেও অভিযোগ উঠে চীনের বিরুদ্ধে।
দশ লাখেরও বেশি উইঘুর এবং ৩০০ জনের মতো তুর্কি সংখ্যালঘুদেরকে অন্যায়ভাবে আটক করে রাখার অভিযোগও উঠে চীনের বিরুদ্ধে। তাদেরকে আটকে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে তাদের উপর। আটক করা ছাড়াও, চীনা সরকার, তুর্কি মুসলমানদের উপর ব্যাপক নজরদারি, তাদের চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জোরপূর্বক তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার একটি ব্যাপক ব্যবস্থা আরোপ করেছে।