শতবর্ষ পরে
–ভীষ্মদেব বাড়ৈ
হারিয়ে যাচ্ছে তো
নদীর না ফেরা ধারার মতো বিলীন হয়ে যাচ্ছে,
ধীরে– ধীরে– অপসৃয়মান!
কতো কিছু হারিয়ে গেছে—
চোখের সামনে এসব বিলীন হয়ে যায়,
তাই কতোকিছু চোখে দেখি না, যেমন চোখের ভীষণ কাছের জিনিস ঝাপসা লাগে!
ও দারুণ, নিদারুণ বিধি কতোকিছু হারিয়ে গেছে!
হারিয়ে যাচ্ছে-
নীল খামে কাগজের চিঠি, বইপড়া, কলম আর কাগজের প্রেম, ডাকঘর, হৃদয়ের ভাষা, অভিসার, মনের মিলন, ডাক পিওনের তাড়া, কামার-কুমোর-জেলে-তাঁতি, বেদেদের গ্রাম, মানুষের সহজ আলাপ, সহজাত ভাষা!
হারিয়ে গেছে—
হারিয়ে যাচ্ছে- আউশ আর আমন ফসল, ধান আর পাটের গোলা, পুকুরের মাছ, ডুব জলে স্নান, গরুর গোয়াল, উনুনের খই, ঋতুর রমন, হাল চাষ, নকশিকাঁথা, লোককথা, রূপকথা, গোধূলি লগন, রাখালের বাঁশি, ঘাটের আত্মকথা, চোরের কাহিনী, পাল্কির রথ, গরুর গাড়ি, চাল ভাঙা ঢেঁকি, ডাল ভাঙা যাতাকল, সরতার বঁটি।
হারিয়ে গেছে—
হারিয়ে যাচ্ছে-
টাংগুলি, হাডুডু, ষোল গুটি, বউচি, চোর-ডাকাত, পাতা গোঁজা, ঘোড় দৌড়, নৈল-নৈল, গোম বাদুর, দাঁড়িয়া খেলা,
হারিয়ে গেছে—-
হারিয়ে যাচ্ছে-
হাতে টানা করাতের কল, পায়ে পায়ে ধানের মাড়াই, শিওলির আজামিঠা, ঝোলা গুড়, খেজুরের রস, শামুক ঝিনুক, দারখিনা-করখিনা, খালে বিলে মাছ ধরা পেটকির চাল,
হারিয়ে গেছে—
হারিয়ে যাচ্ছে- বোনের মায়া, ভাইয়ের আদর, প্রেমিকার শাড়ি, মায়ের আঁচল, ধূতি-পাঞ্জাবি, প্রেম-পিরীতি, ভালোবাসা-স্নেহ, বিরহ-অনল, প্রসব বেদনা;
টেক্স আর মেসেজ এ আমাদের কথা বলা হারিয়ে গেছে,
বন্ধুত্ব, সংবেদন, হৃদয়ের আড্ডা হারিয়ে গেছে,
আমাদের জড়িয়ে ধরেছে সব শারীরিক মোহ, পৈশাচিক প্রেম,
ভালোবাসা ভালো করে
কোন গ্রহে হারিয়ে গেছে—-
আমাদের অনেক কিছু হারিয়ে গেছে:
বাবা ডাক, বাপি আর ড্যাড্ডিতে হারিয়ে গেছে,
মা- মাম্মিতে হারিয়ে গেছে, প্রেমিক- লাভার এ হারিয়ে গেছে,
বন্ধু- দোস্ততে হারিয়ে গেছে,
হৃদয়- জানুতে হারিয়ে গেছে
বাগদত্তা- লিভ ইন এ হারিয়ে গেছে,
প্রেম আর ভালবাসা-
শরীর আর দেহে-দেহে হারিয়ে গেছে,
জীবন- জীবিকা আর রোজগারে হারিয়ে গেছে,
আত্মা- প্রেতাত্মায় হারিয়ে গেছে,
মানুষ- অমানুষে হারিয়ে গেছে!
পৃথিবী ছায়াপথে হারিয়ে গেছে।
হে শতবর্ষের অনাগত আগামী আমার,
হে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমার,
আমি জানি- তোমাকে হাঁটতে হবে না সেদিন পা দিয়ে, খেতে হবে না হাত দিয়ে, তোমাকে দেখতে হবে না চোখ দিয়ে,
তোমাকে খেতে হবে না পেট দিয়ে, তোমাকে ঘুমাতে হবে না আর চোখ দিয়ে,
সব কিছু হয়ে যাবে চোখ ঈশারায়!
সবকিছু হয়ে যাবে কলের খেলায়!
থাকবে না হৃদয় বলে কোনো শব্দ, প্রেম বলতে কোনো অনুভব,
থাকবে না মুখের ভাষা, থাকবে না হৃদয়ের আশা, থাকবে না কোনো স্বপ্ন, থাকবে না কোনো কল্পনা,
শরীরে কোনো প্রেমিকা নয়- মেশিনের উত্তাপ খেলা করবে দিন-রাত,
গরম ভাতে আলুভর্তা আর ঘি কেমন লাগবে কোনোদিন তা বুঝবে না তোমরা।
হে প্রজন্ম আমার,
একশো বছর পিছনে বসে আমি আজ কল্পনা করছি তোমাদের, তোমরা কেমন হবে?
কেমন হবে তোমাদের অনাগত সভ্যতা?
তোমাদের অনাগত সভ্যতায় আমি টাইম মেশিনে উড়ে যাচ্ছি একশ বছর আগামীতে,
আমার প্রজন্ম তুমি,
এ কথা ভাবতে ভালোই লাগে,
এ জন্ম একদিন অনাগত তোমাতে শতজন্মে হারিয়ে যাবে-
এ কথা ভাবতেই বেশি ভালো লাগে।
এসি/ আই. কে. জে/
আরো পড়ুন:
একদিন সহস্র জীবন : ভীষ্মদেব বাড়ৈ