নিজস্ব প্রতিবেদক, সুখবর ডটকম: পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, সারাবছর এখানে শাঁখা, পিতল আর নানারকম পূজার সামগ্রী বিক্রি হলেও সাকরাইন উৎসবের আগে এটি হয়ে ওঠে ঘুড়ির গলি। এখানে স্থায়ী ঘুড়ির দোকান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মৌসুমি ঘুড়ির দোকান। সাকরাইন উপলক্ষে ঘুড়ি কেনাবেচা শুরু হয়।
নানা বয়সী ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই গলি। পৌষ সংক্রান্তি উৎসবের এই ঢাকাইয়া আয়োজনের মূল উপভোগ্যই ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে।
ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তির এই দিনকে বলা হয় সাকরাইন। আদি ঢাকাই লোকদের পিঠাপুলি খাবার উপলক্ষ আর সাথে ঘুড়ি উড়াবার প্রতিযোগিতার দিন। সাকরাইন একান্তই ঢাকার, যুগের পরিক্রমায় তাদের নিজস্ব উৎসব। যা ঢাকার জনপ্রিয় ও দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার ফল।

সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সংক্রাণ থেকে এসেছে। আভিধানিক অর্থ: বিশেষ মুহূর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয় সাকরাইন।
আদিকাল থেকেই এ শহরে মানুষ ঘুড়িবাজ হিসেবে পরিচিত। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। এখানে ঘুড়ি উড়ানোর কারুকাজ ও কলাকৌশলে অবাক হয়ে ঐতিহাসিকরাও এর মুগ্ধতা প্রকাশ করে গিয়েছেন।
ঢাকার নায়েব নাজিম ও নবাবেরা ছিলেন এই কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এক সময় স্থানীয় নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় লখনৌর আকাশ রংবেরঙের ঘুড়ি আর আতশবাজির আলোকসজ্জায় পূর্ণ থাকত। এ উৎসবকে পাতাংবাজীও বলা হত।
যতদূর জানা যায়, ঘুড়ি উড়ানো উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় নবাব আসাফউদ্দৌলার সময় থেকে। হিন্দু শাসিত শহরে তারা পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সব সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলিমসহ অন্য ধর্মের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা।

শীত মৌসুমের তিন মাস ঢাকার লোকদের ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। ছিল না নিদিষ্ট কোনো দিন। পৌষের শেষ দিনটাকেই তারা বেছে নিতেন ঘুড়ি উড়াবার শেষ মৌসুমী উপলক্ষ হিসেবে। ঢাকার ঘুড়িবাজরা নেমে পড়তো খোলা মাঠ ও মহল্লার ছাদগুলোতে।
ঢাকাইয়াদের কাছে পৌষের বিদায় ক্ষণটি অর্থ্যাৎ শেষদিন হলো এই লড়াই ও পিঠাপুলি খাওয়ার উৎসবের দিন। আবার ঢাকার তাঁতিবাজার ও শাখারিবাজারের হিন্দু সম্প্রদায় এই ঘুড়ি খেলার উৎসবটি ১লা মাঘ মেনে একদিন পরে পালন করেন।
সন্ধ্যা নামতেই আকাশে শুরু হতো পটকা আর আতশবাজির খেলা। বুড়িগঙ্গার তীর আলোকিত হয়ে উঠতো আলো ঝলমলে রঙ্গীন আভায়। ৬০ দশকে যুক্ত হয় মাইকের দাপট, কিন্তু বিবর্তন ও প্রযুক্তি যোগ করেছে হাইপাওয়ার সাউন্ড সিস্টেম ও গান। কালের ধারাবাহিকতায় উৎসবে অনুসঙ্গের পরিবর্তন এলেও আমেজ ও আবেগটা কিন্তু এখনও প্রজন্মান্তরে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতই।
পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন এই শহরে হিন্দু-মুসলিমসহ সবার সার্বজনীন এক সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে আজও টিকে আছে। পালিত হচ্ছে ঐক্য ও বন্ধুত্বের প্রতীক হয়ে।
এমএইচডি/ আই. কে. জে/
আরও পড়ুন:
কুমিল্লায় হারানো গ্রামীণ ঐতিহ্য নিয়ে জাদুঘর