বিতর্কিত চার দিন, ১৫ রাউন্ডের নির্বাচন এবং ইতিহাসের পঞ্চম দীর্ঘতম প্রতিযোগিতার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ অবশেষে ক্যালিফোর্নিয়া রিপাবলিকান কেভিন ম্যাকার্থিকে কংগ্রেসের পরবর্তী স্পিকার হিসেবে বেছে নিয়েছে।
১৫তম নির্বাচনটি শুক্রবার বিকাল থেকে শুরু হয়ে শনিবার পর্যন্ত চলে। এত নাটকীয়তার পর ম্যাকার্থি অবশেষে সফল হন সর্বোচ্চ ভোট সংগ্রহ করতে নিজের ঝুলিতে।
৩ জানুয়ারি, যখন কংগ্রেস নতুন অধিবেশনের জন্য আহ্বান জানায় এবং পরবর্তী হাউস স্পিকারের জন্য ভোটদান শুরু করে, তখনও ম্যাকার্থি সর্বোচ্চ ভোট সংগ্রহ করতে পারবেন কি না এ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল।
গত বছর, মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর, রিপাবলিকানরা ডেমোক্র্যাট এবং বিদায়ী স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির কাছ থেকে ২২২-২১৩ সংখ্যার সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হাউস দখল করে। পরবর্তীকালে, একই মাসে জিওপি সম্মেলনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর, ম্যাকার্থি তার দলের জন্য হাউসের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তবে এটাও সঠিক যে, সদস্যরা তাদের দলের নির্বাচিত প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য নন।
তবে ব্যক্তি যদি হাউসের সদস্য হন, তবে এর প্রয়োজনও পড়ে না। কারণ তখন সিনেটর, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনসহ একাধিক আইন প্রণেতাদের কাছে স্পিকারের প্রার্থীতা উন্মুক্ত হয়ে যায়। যদিও তাদের কেউই এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে সক্ষম হতে পারেন নি। ডেমোক্র্যাটরা স্পিকার পদের জন্য হেকিম জেফ্রিসকে মনোনীত করেন। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা মনোনীত করেন কেভিন ম্যাকার্থিকে।
ম্যাকার্থি কমপক্ষে ২১৮ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে আপাতদৃষ্টিতে অক্ষম ছিলেন। শতাব্দীর মধ্যে এই প্রথমবার একজন স্পিকার নির্বাচনের জন্য এতবার নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ল। ওয়াশিংটনে আইন প্রণেতারা কেবল কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে সভাপতিত্বই করেন না, বরং রাষ্ট্রপতি পদের জন্য লড়াইয়েও সামিল হন।
স্পিকার পদের জন্য ম্যাকার্থিকে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে সবচেয়ে কঠিন ছিল তার নিজের দলেরই কট্টরপন্থীদের সাথে মোকাবেলা করা। এ পরিস্থিতি ক্যালিফোর্নিয়ার এই রিপাবলিকানের জন্য বেশ জটিল হয়ে উঠেছিল যখন তিনি এতবার নির্বাচনের পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারছিলেন না।
রিপাবলিকান পার্টির সমালোচনামূলক একটি ছোট দল চাইছিল স্পিকার হওয়ার জন্য ম্যাকার্থি যেন তাদের সাথে সমঝোতা করেন। মূলত এ সমঝোতার অর্থ দাঁড়ায় ম্যাকার্থি নিজের প্রভাব নিজেই কমিয়ে ফেলবেন। তবে ভোটের ১৪ তম রাউন্ডের পর, যখন ম্যাকার্থিরই প্রতিনিধি ম্যাট গেটজ তার ভোট প্রত্যাহার করে নেন, তখন ৫৭ বছর বয়সী ম্যাকার্থি বেশ অপমানিত বোধই করেন।
১৪তম রাউন্ডের পর, ম্যাকার্থি ২১৬ ভোট অর্জন করতে সক্ষম হন, অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জেফ্রিস পান ২১২ ভোট।
পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত চলে যায় ফ্লোরিডার আইনপ্রণেতা, গেটজের হাতে। তিনি ১৪তম রাউন্ডের সময় চেম্বার থেকে বেরিয়ে যান এবং ১৫ তম রাউন্ডে শুধু উপস্থিত ভোট প্রদান করেন।
তবে শেষ রাউন্ডের আগে ম্যাকার্থি গেটজের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেন। এরপরই আরো অনেক আইনপ্রণেতারাও তার সাথে আলোচনা করতে আসেন। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে।
অনেক আলাপ আলোচনার পর, এরিজোনার প্রতিনিধি অ্যান্ডি বিগস, এরিজোনার প্রতিনিধি এলিজা ক্রেন এবং ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধি বব গুড উপস্থিত ভোট প্রদান করে ম্যাকার্থিকে জয়লাভের পথে এগিয়ে দেন।
তবে এখানে এমন ২০ জন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা রয়েছেন যারা প্রথমে ম্যাকার্থির বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে তাকে জয়লাভে সহযোগিতা করেন।
রিপাবলিকান এই আইন প্রণেতারা হলেন, এরিজোনার অ্যান্ডি বিগস, উত্তর ক্যারোলিনার ড্যান বিশপ, কলোরাডোর লরেন বোয়েবার্ট, ওকলাহোমার প্রতিনিধি নির্বাচিত জোশ ব্রেচিন, টেক্সাসের মাইকেল ক্লাউড, জর্জিয়ার অ্যান্ড্রু ক্লাইড, এরিজোনার প্রতিনিধি-নির্বাচিত এলি ক্রেন, ফ্লোরিডার বায়রন ডোনাল্ডস, ফ্লোরিডার ম্যাট গেটজ, ভার্জিনিয়ার বব গুড, এরিজোনার পল গোসার, মেরিল্যান্ডের অ্যান্ডি হ্যারিস, ফ্লোরিডার প্রতিনিধি-নির্বাচিত আনা পলিনা লুনা, ইলিনয়ের মেরি মিলার, দক্ষিণ ক্যারোলিনার রাল্ফ নরম্যান, টেনেসির অ্যান্ডি ওগলস, পেনসিলভেনিয়ার স্কট পেরি, মন্টানার ম্যাট রোসেনডেল, টেক্সাসের চিপ রয় এবং টেক্সাসের কিথ সেলফ।
বেশ কয়েকটি রাউন্ড ভোটের পরে একটি নাটকীয় পরিবর্তনে, ম্যাকার্থি এবং তার সহযোগীরা শুক্রবার ১৪তম রাউন্ডের ভোটের আগে কমপক্ষে এক ডজন ভোট পরিবর্তন করাতে সক্ষম হন।
সিনেট এবং হোয়াইট হাউসে ডেমোক্র্যাটরা দীর্ঘকাল ধরেই ব্যয় কমানোর বিরোধিতা করে আসছিল এবং রিপাবলিকানদের অবস্থান ছিল তার ঠিক বিপরীতে। কিন্তু তারা সেখানে বিশেষ একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
তবে ২০২২ সালে, ম্যাকার্থি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে প্রতিরক্ষা ও ঘরোয়া কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আসন্ন অর্থবছরের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ কমানোর কথা জানান। বর্তমান স্পিকার হলম্যান এতে সম্মত হন এবং এটি সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর কারণও হয়ে উঠতে পারে।
ম্যাকার্থির জয়ের পর একটি বিবৃতিতে, ডেমোক্র্যাট চক শুমার বলেছেন, স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির স্বপ্নের এ পদ আমেরিকান জনগণদের জন্য একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। কারণ ভোট লাভের জন্য, তিনি রিপাবলিকান পার্টির একটি প্রান্তিক দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
ফলাফল ঘোষণার পর ম্যাকার্থি তার কাঙ্ক্ষিত জয়লাভে অত্যন্ত খুশি হোন। রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা গিভলটিও ম্যাকার্থির এ আনন্দে সামিল হোন। পরবর্তীতে ম্যাকার্থিকে অফিসে শপথ নিতে দেখা যায়।
তিনি বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং তার প্রশাসনকে নিজেদের দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, এবার তিনি ওয়াশিংটনের অপচয় বন্ধ করতে, মুদি, গ্যাস, গাড়ি, বাসস্থানের দাম কমাতে এবং ক্রমবর্ধমান জাতীয় ঋণ বন্ধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আশা রাখছেন যে এবার আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ, ঋণ এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উত্থানকেও মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে হাউস সংখ্যালঘু নেতা এবং ডেমোক্র্যাট হাকিম জেফ্রিস কংগ্রেসে একটি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইন প্রণেতা হয়ে ইতিহাস তৈরি করেছেন। প্রাক্তন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি পদত্যাগ করায় নিউইয়র্কের এই ডেমোক্র্যাট এ দায়িত্ব নেবেন। গত নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর ডেমোক্র্যাটিক ককাস তাকে নির্বাচিত করেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ৫২ বছর বয়সী হাউস ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে তিনিই প্রথম নেতা যার জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর।
এক বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ম্যাকার্থিকে তার জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, তিনি এখনো রিপাবলিকানদের সাথে একত্রে কাজ করতে রাজি আছেন এবং আশা রাখছেন রিপাবলিকানরাও দেশের স্বার্থে তার সাথে একত্রে কাজ করতে রাজি হবে।
অন্যদিকে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ম্যাকার্থিকে তার জয়ের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
আই. কে. জে/