সাইদ মাহবুব, সুখবর ডটকম: “লোকসংগীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর”- মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে হাজারী গুড়ের নাম। হাজারী গুড় স্থান পেয়েছে জেলার ব্র্যান্ডিংয়ে। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার কয়েকটি গাছি পরিবার এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এক সময় হাজারী গুড়ের সুনাম এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। আগে অনেকেই এই গুড় তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকলেও নানা কারণে তারা পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে এখনো টিকে আছে বেশ কয়েকটি পরিবার। তাদের হাত ধরেই টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী এই হাজারী গুড়।
- হাজারী গুড় নিয়ে প্রচলিত উপকথা:
গুড়ের নাম কেন হাজারী গুড়- এ ব্যাপারে জনশ্রুতিতে দুটি গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি দৈবশক্তিসম্পন্ন কোনো এক দরবেশ ও অন্যটি রানি এলিজাবেথকে ঘিরে।
কয়েকশ বছর আগে ঝিটকা অঞ্চলে মোহাম্মদ হাজারী নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। হঠাৎ একদিন বিকালে খেজুর গাছে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ তার কাছ রস খেতে চান। তখন ওই গাছি দরবেশকে বলেছিলেন, ‘সবে মাত্র গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এতো অল্প সময়ে বড় জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে।’
তবুও দরবেশ তাকে গাছে উঠে হাঁড়ি থেকে রস খাওয়াবার অনুরোধ জানান। দরবেশের রস খাওয়ার অনুরোধে গাছি আবার খেজুর গাছে ওঠেন। এরপর বিস্মিত হয়ে দেখতে পান, অল্প সময়ের মধ্যেই সারারাত ধরে যে পরিমাণ রস পড়তো সে পরিমাণ রসে হাঁড়ি ভরে গেছে। গাছি হাঁড়ি ভরপুর রস নিয়ে নিচে নেমে ওই দরবেশকে রস খাওয়ান এবং পা জড়িয়ে ধরেন।
গাছিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে দরবেশ বলেন, ‘কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সবাই খাবে এবং তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে’ বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওই দরবেশকে আর পাওয়া যায়নি। ওই দিন থেকেই মোহাম্মদ হাজারী নামেই এ গুড়ের ‘হাজারী’ নামকরণ হয়।
অন্য গল্পটি হলো, ব্রিটিশ আমলে রানি এলিজাবেথ ভারতবর্ষ সফরে এসেছিলেন। তার খাবার টেবিলে দেওয়া হয়েছিল এই গুড়। রানি গুড় হাতে নিয়ে একটু চাপ দিতেই ‘হাজার’ টুকরো হয়ে গিয়েছিল। গুড় খেয়ে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। পরে উপহার হিসেবে ‘হাজারী’ লেখা পিতলের একটি সিলমোহর উপহার দেন তিনি। এরপর থেকেই হাজারি গুড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পিতলের সেই সিলমোহরটি এখনো পরিবারের কাছে সংরক্ষিত আছে।
- হাজারী গুড় তৈরির পদ্ধতি:
এ গুড়ের উৎস খেজুরের রস। গাছির রস নামানো থেকে শুরু করে গুড় তৈরির মধ্যে রয়েছে আদি এক প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও হাজারি গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়ার কোনও পরিবর্তন নেই বলে জানিয়েছেন গাছিরা। তারা আরো বলেন- বেশি শীত অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ গুড় উৎপাদনের উপযুক্ত সময়।
এছাড়া সাধারণ গুড়ের চেয়ে হাজারী গুড় তৈরিতে পরিশ্রম বেশি। অন্যান্য গুড়ের উৎপাদন কৌশল থেকে এর উৎপাদন কৌশল একটু আলাদা। ভোর থেকেই শুরু হয় গাছি পরিবারের ব্যস্ততা। গাছিরা খেঁজুর গাছ থেকে রস ভর্তি হাঁড়ি সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসেন। সেই রস মাটির চুলায় কড়াইতে ঢেলে জ্বাল দেওয়া হয়। এরপর মাটির একটি বিশেষ পাত্রে (স্থানীয়রা একে জালা বলে) ফুটন্ত রস ঢেলে কাঠ কিংবা তালের লাঠি দিয়ে নাড়াচাড়া করা হয়। অনেকক্ষণ ধরে ঘুটানোর পর রস বাদামি রং হয়। এরপর সেই গুড় মাটির ছোট পাত্রে সাজ বা পাটালি বানানো হয়। এই গুড়কে পাটালি গুড়ও বলা হয়। এরপর রাণীর দেয়া উপহার হাজারী লেখা সিল মেরে বিক্রি করা হয়। আগে খোলাভাবেই হাজারী গুড় বিক্রি করা হলেও এখন হাজারি প্রোডাক্টসের নামে প্যাকেটজাত করা হয়।
জহির উদ্দিন হাজারী বলেন, বহু বছর ধরে আমরা হাজারি পরিবারের সদস্যরাই এ গুড় তৈরি করে আসছি। কিন্তু অনেকেই এখন পেশা ছেড়েছেন। বর্তমানে হাজারী পরিবারের দুই সদস্যসহ ২২টি পরিবার এ গুড় তৈরির সঙ্গে জড়িত। শীতের এই সময়টাতে হাজারী গুড় তৈরি করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। হাজারী পরিবারের অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ হাজারী গুড় তৈরি করতে পারবে না। গুড় তৈরির পর পাটালির গায়ে হাজারী ব্যান্ডের সিল দেওয়া হয়। যাদের অনুমতি আছে একমাত্র তারাই এই সিল ব্যবহার করতে পারেন।
ঝিটকা এলাকায় বসবাস করা ও গুড়ের কারিগর গাছি রহমান বলেন, হাজারী পরিবারের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই হাজারী গুড় তৈরি করে আসছি। এই গুড় তৈরিতে অনেক পরিশ্রম। গাছকাটা, হাঁড়িধোয়া, রস জ্বাল দেওয়াসহ গুড় বানানোর প্রতিটি ধাপেই বাড়তি কৌশল ও সর্তকতার প্রয়োজন হয়। যা সাধারণ গুড়ের পাটালি তৈরিতে লাগে না। সাধারণ পাটালি বা খেজুরের গুড়ের চেয়ে হাজারী গুড়ের পার্থক্য অনেক। সাধারণ গুড় দেখতে লাল রংয়ের হয়। আর হাজারী গুড়ের রং হয় সাদা। যার ঘ্রাণটাই অন্যরকম। মুখে দেওয়ার পর গলে যায়। হাতের মুঠোতেই ভাঙ্গা যায়।
- হাজারী গুড়ের দাম:
হাজারী গুড়ের চাহিদা এতোই বেশি যে, এ গুড় তৈরি করার কয়েক মাস আগেই অর্ডার থাকে। মানিকগঞ্জে গুড়ের বাজারে খেজুর গুড়ের বিশাল পসরা বসলেও হাজারী গুড় সেখানে অনন্য। তাই এর দাম প্রচলিত পাটালির তুলনায় পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ গাড়ি নিয়ে আসেন গুড় নিতে। বর্তমানে ভালো মানের এক কেজি হাজারী গুড় ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হয়।
- প্রতিবন্ধকতা:
এক শ্রেণির অসাধু লোক ভেজাল গুড়ের উপর ‘হাজারী’ নাম খোদাই করে এসব গুড় বাজারজাত করে আসছে। খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। জ্বালানির সমস্যা রয়েছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ না নিলে ঐহিত্যবাহী এই গুড়শিল্প একসময় কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে দিন দিন খেঁজুর গাছ আর গাছি সংকট দেখা দেওয়ায় গুড়ের উৎপাদন অনেক কমেছে। ফলে চাহিদা মতো গুড় সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে যাচ্ছে হাজারী গুড়। হাজারী গুড় টিকিয়ে রাখতে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারিভাবে রাস্তার দুই পাশসহ বিভিন্ন জায়গায় খেঁজুর গাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ জেলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে হাজারী গুড়। এই গুড় আর কোথাও তৈরি হয় না। স্থান দেওয়া হয়েছে জেলা ব্র্যান্ডিংয়েও। তাই গুড়ের গুণগতমান ও উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
হাজারী নামে যেন কোনো ভেজাল গুড় বাজারে আসতে না পারে এজন্য ভোক্তা অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান চলছে। পাশাপাশি ওই এলাকায় সরকারি-বেসরকারিভাবে খেজুর গাছ রোপণ করা হবে। সেখান থেকে প্রচুর গুড় উৎপাদন সম্ভব হবে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে।
আই. কে. জে/
আরো পড়ুন:
বাড়লো বিয়ে ও তালাকের খরচ : বিধিমালা সংশোধন