নিজস্ব প্রতিবেদক, সুখবর ডটকম: এক অধিবেশনে ভারতীয় বুকারজয়ী লেখক গীতাঞ্জলি শ্রী বলছিলেন, ‘চারপাশে সবসময়ই অনেক কণ্ঠস্বর ঘিরে আছে আমাদের। আমরা নিজেরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রকাশ করি আলাদা আলাদা স্বরে।’
শিক্ষক, গবেষক ও নাট্যনির্দেশক অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ অন্য অধিবেশনে বললেন, ‘নাটকে দর্শকের মনে নাড়া দেওয়া প্রয়োজন। নাটকে প্রশ্ন করা অত্যাবশকীয়’।
অন্য অধিবেশনে অমিতাভ ঘোষ বললেন, ‘দক্ষিণ এশীয় ঔপন্যাসিকরা মানুষের আবেগ ও সম্পর্ক নিয়ে খুব খোলামেলা লেখেন। এছাড়াও বিস্তৃত রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়েও আলোকপাত করেন। আমাদের বইগুলোতে খুব মানবিক পরিস্থিতির অবতারণা করা হয়। ফলে সেগুলোর একটি সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। আশা করি দক্ষিণ এশিয়ার লেখকরা এই দিকটি ধরে রাখবেন।’
দেশি-বিদেশি লেখক-পাঠক, প্রকাশক ও শিল্পীদের আনাগোনায় মুখর ঢাকা লিট ফেস্টের আঙিনা। লেখকদের ঘিরে তরুণদের আলোচনা, সেশনগুলোতে উন্মুখ শ্রোতা। আলোচনায়, আড্ডায় মুখর পুরো উৎসব চত্বর। বাংলা একাডেমির সবুজ চত্বর পরিণত হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায়। গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, কবিতা তথা সাহিত্যের নানা ক্ষেত্র নিয়ে চলা সেশনের পাশাপাশি নাচ, গান এবং বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলাও উপভোগ করেছে দর্শনার্থীরা। অনেকেই মগ্ন ছিলেন বই কেনায়।
লিট ফেস্ট আয়োজন আমাদের বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে একটা যোগাযোগ সৃষ্টি করছে ঠিক কিন্তু আমাদের লেখকরা তাদের লেখা নিয়ে কেন বিশ্বসভায় উঠে আসতে পারছেন না। লিট ফেস্টে এসে অনেকের মনেই এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলছিলেন, ‘এ ধরনের আয়োজন থেকে আমরা যেমন বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় তুলে ধরতে পারি তেমনিভাবে বিশ্বসভাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারি।’
বাংলা সাহিত্য কেন বিশ্বসভায় স্থান করতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলছিলেন, ‘একটি দেশের সাহিত্য তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন সেই দেশটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একসময় দেখলাম জাপানের সাহিত্যিকরা নোবেল পেতে শুরু করলেন। এরপর দেখলাম চীন, সিরিয়া, আফগানিস্তানের লেখকরা নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। এ থেকে বোঝা যায়—পশ্চিমা বিশ্ব, আমেরিকার আগ্রহ সেদিকে। যদি অর্থনৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে আমরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারি তখনই আমাদের লেখকরাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যে কোনো বিচারে শ্রেষ্ঠ। আমাদের শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে কোনো বিচারে নোবেল পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু বিশ্বসভায় আমরা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারছি না। হোলি আর্টিজান, জঙ্গি— এসব ঘটনায় প্রাসঙ্গিক হলে হবে না। হতে হবে সামগ্রিক যোগ্যতা দিয়ে।’
এদিকে, গতকাল প্রথম বারের মতো দর্শকের মুখোমুখি হয়েছিলেন তানজানিয়ার বংশোদ্ভূত ২০২১ সালে নোবেলজয়ী লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ। তার কথায় প্রাণিত হয়েছেন দর্শকরা।
গতকাল তৃতীয় দিন উত্সবের সূচনা হয় গুরুদুয়ার গান দিয়ে। এরপর সারা দিনে ৫১টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এর পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আবৃত্তি সন্ধ্যার আয়োজনও ছিল উৎসবে।
গতকাল দুপুরে বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে ‘কালচার কিপারস’ সেশনে এলিজাবেথ ডি কস্টার সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন লেখক ইয়াং ইয়াং ম্রো, উদ্যোক্তা প্রিয়াঙ্কা চাকমা, পরিচালক অং রাখাইন।
শুরুতে ইয়াং ইয়াং ম্রো তার ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘স্কুলে যখন আসলাম শিক্ষকরা সবাই বাঙালি। আমরা তো বাংলা বুঝি না, শিক্ষকরা ম্রো বোঝেন না। একদিন এক শিক্ষক ক্লাসে কথা না বলার জন্য বললেন, আমরা নমস্কার বললাম। উনি বললেন, চুপ। আমরা বললাম নমস্কার। ম্রো ভাষায় বাংলার এই একটা শব্দই আছে, চুপ মানে ম্রোতে নমস্কার। আমি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ম্রোতে অনুবাদ করি। ম্রোরা বাংলা পড়তে জানে না। এখন অনেকেই এই ভাষণ সম্পর্কে জানে।’
এদিকে, ‘টুম্ব অব স্যান্ড’ শীর্ষক সেশনে রিফাত মুনীরের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বুকারজয়ী ভারতীয় ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলী শ্রী এবং অনুবাদক ডেইজি রকওয়েল।
শুরুতে সঞ্চালক নিজের বই ‘টুম্ব অব স্যান্ড’ বিষয়ে বলতে আহ্বান জানান লেখক গীতাঞ্জলি শ্রী-কে। লেখকের মতে, চারপাশে সবসময়ই অনেক কণ্ঠস্বর ঘিরে আছে আমাদের। আমরা নিজেরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রকাশ করি আলাদা আলাদা স্বরে। এই বইয়েও পৃথক পৃথক অনেক কণ্ঠের বয়ান রয়েছে। আমাদের খুঁজে পেতে হবে নিজের স্বর, আর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা। এতে আমাদের সাহায্য করবে।
লেখার প্রক্রিয়া ও বিস্তৃত বিষয়াদি তিনি একসূত্রে কীভাবে তার লেখা গাঁথেন এই প্রশ্নের জবাবে গীতাঞ্জলি শ্রী বলেন, ‘আমাদের চারপাশেই আছে গল্পের উপাদান, এরা আমার মাঝে প্যারালাল ইউনিভার্স তৈরি করে। গল্প হয়ে বেরোতে চায়। তখন আমি লিখতে বসি। একবার লেখা শুরু করলে গল্পই আমার লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।’
এম/ আই. কে. জে/
আরো পড়ুন:
কুয়াশার দাপট কমেছে, সুখবর দিল আবহাওয়া অফিস