নিজস্ব প্রতিবেদক, সুখবর ডটকম: স্লিপিং ব্যাগ এক ধরনের হালকা এবং আরামদায়ক বিছানা। সাধারণত ঘরের বাইরে ব্যবহারের জন্য। ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ, ক্যাম্পিং, হাইকিং বা পাহাড়ে ওঠার অভিযানে স্বল্পকালীন রাত্রি যাপনে স্লিপিং ব্যাগের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী। ঘুমানোর বিছানা হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়।
একই সঙ্গে গন্তব্যে প্রয়োজনীয় যে কোনো কিছু বহনেও ব্যাগের মতো ব্যবহার করা হয়। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার এবং সহজ বহন করার সুবিধা থাকায় স্লিপিং ব্যাগের গুরুত্ব বেড়েছে। একজনের ব্যবহার উপযোগী স্লিপিং ব্যাগের ব্যবহারই বেশি।
তবে কয়েকজনের ব্যবহার এবং শিশুর উপযোগী স্লিপিং ব্যাগও রয়েছে। বৈরী পরিবেশে ব্যবহারের সুবিধায় বিভিন্ন ডিজাইন এবং আকারের হয়ে থাকে। কোনোটি গরমে দেয় শীতলতা, শীতে দেয় উষ্ণতা। আবহাওয়া ও তাপমাত্রা বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরনের স্লিপিং ব্যাগ তৈরি করা হয়। আকৃতিতেও আছে রকমফের। টিউব, চার কোনা ইত্যাদি।
দশ বছর ধরে স্লিপিং ব্যাগের রপ্তানি করে আসছে বাংলাদেশ। এই দশ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৮২ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার মূল্যমানের স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানির মাধ্যমে বিশেষায়িত এই পোশাকপণ্যের বাজারে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ কোটি ডলার মূল্যের স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। গত অর্থবছরের রপ্তানি ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ৫৯ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ২ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার মূল্যমানের স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানি হয়। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্লিপিং ব্যাগের রপ্তানির পরিমাণ আরও বেশি ছিল, যার পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ডলার।
বর্তমানে ৪০টিরও বেশি দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্লিপিং ব্যাগ। তবে যুক্তরাষ্ট্রেই যায় মোট রপ্তানির ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে মোট ১ কোটি ৭৬ লাখ ডলার মূল্যের স্লিপিং ব্যাগ গেছে দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে বাংলাদেশের স্লিপিং ব্যাগের ওপর ১২ শতাংশ শুল্ক্ক আরোপ রয়েছে।
বাংলাদেশের স্লিপিং ব্যাগের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি বাজার ফ্রান্স। গত অর্থবছরে স্লিপিং ব্যাগের মোট রপ্তানি আয়ের ২৩ শতাংশ এসেছে ইউরোপের এই দেশ থেকে। রপ্তানি হয়েছে ১০ লাখ ডলারের পণ্য। অন্যান্য প্রধান বাজারের মধ্যে রয়েছে- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ইত্যাদি। স্লিপিং ব্যাগের বাজার আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে পোশাক পণ্যের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা পুনরুদ্ধার হয়েছে বাংলাদেশের। পোশাক খাতের একক পণ্য হিসেবে স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
২০২০ সালে পোশাক খাতের মোট রপ্তানির বিবেচনায় ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা হারালেও স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানিতে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল। টানা ১০ বছর এ অবস্থান দখলে রয়েছে বাংলাদেশের। চীন সরকার জাতীয়ভাবে তৈরি পোশাক উৎপাদন নিরুৎসাহিত করছে। পোশাক থেকে উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ বাড়িয়েছে দেশটি।
ফলে স্লিপিং ব্যাগের বেড়ে চলা বিশ্ববাজারে প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে বাংলাদেশ। খুব সহজেই রপ্তানি কয়েকগুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনায় এবং ইপিবির পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনার সবটুকু এখনও ব্যবহার করা হয়নি।
এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে আরও অন্তত ৪০ লাখ ডলারের স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানি করার সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। জার্মানিতে প্রায় ১ কোটি ডলার রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। প্রায় সব দেশেই স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানিতে সক্ষমতার শতভাগ কাজে লাগাতে পারলে রপ্তানি বর্তমানের কয়েকগুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
বিশ্ববাজার বেড়েছে ৪৭%
গত ১০ বছরে স্লিপিং ব্যাগের বিশ্ববাজার বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। ২০১২ সালের ৪৭ কোটি ডলারের বাজার এখন বছরে ৭০ কোটি ডলারের। এই হিসাব ২০২১ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে স্লিপিং ব্যাগের চাহিদা বৈশ্বিক মোট চাহিদার ২৬ শতাংশেরও বেশি। গত বছর দেশটি ১৮ কোটি ডলারের স্লিপিং ব্যাগ আমদানি করে বিভিন্ন দেশ থেকে।
আগের বছরের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি বেড়েছে ৮৩ শতাংশ। স্লিপিং ব্যাগের দ্বিতীয় প্রধান বাজার জার্মানি। মোট বৈশ্বিক চাহিদায় দেশটির অংশ ৮ শতাংশ। গত বছর জার্মানির আমদানি বেড়েছে ৫৬ শতাংশেরও বেশি। মোট সাড়ে ৫ কোটি ডলারের স্লিপিং ব্যাগ আমদানি করে জার্মানি। স্লিপিং ব্যাগের তৃতীয় প্রধান বাজার জাপান। বিশ্ববাজারের দেশটির চাহিদা ৬ শতাংশের বেশি। গত বছর আমদানি বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৪১ শতাংশ।
প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডলার মূল্যের স্লিপিং ব্যাগ ব্যবহার করেছে জাপানিরা। অন্যান্য বড় বাজারের মধ্যে রয়েছে- ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি ২০২২ সালেই বাজার বেড়ে হবে ১৭৪ কোটি ডলারের। ২০৩২ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়ে ৩৪৬ কোটি ডলারের উন্নীত হতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্লিপিং ব্যাগের উৎপাদন এবং রপ্তানি বিভিন্নভাবে দেশের পোশাক খাতে মূল্য সংযোজন বাড়াবে।
কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার বা ম্যানমেইড ফাইবারের পোশাক হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে উচ্চমূল্য পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে নতুন ক্রেতা এবং নতুন বাজারে প্রবেশ সহজ হবে। আবার স্লিপিং ব্যাগকে কেন্দ্র করে পোশাক খাতের অন্যান্য পণ্যেও ক্রেতাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। সর্বোপরি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার প্রচেষ্টায়ও সহায়ক হবে।
চীনের দখলেই ৬০% বাজার
বস্ত্র ও পোশাক খাতের অন্যান্য পণ্যের মতো স্লিপিং ব্যাগের বিশ্ববাজারও চীনের দখলে। চীন একাই বৈশ্বিক মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ জোগান দেয়। গত বছরে চীন ৪৭ কোটি ডলার মূল্যের স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানি করেছে। গত ১০ বছরে এই পণ্যের চীনের রপ্তানি বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। তবে এই দশ বছরে স্লিপিং ব্যাগের বিশ্ববাজার বেড়েছে ৫৯ শতাংশ হারে। স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানিতে বাংলাদেশের পরই ভিয়েতনামের অবস্থান। ইউরোপের কয়েকটি দেশও স্লিপিং ব্যাগ উৎপাদন করে থাকে। স্পেন এবং জার্মানি রয়েছে স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানিতে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে। যথাক্রমে পরবর্তী অবস্থানগুলোতে রয়েছে অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও ফ্রান্স।
যেসব চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ থেকে অনেক কারখানাই স্লিপিং ব্যাগ উৎপাদন ও রপ্তানি করে থাকে। কয়েকটি কারখানার উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রচলিত পণ্যই বেশি উৎপাদন করে। কোনো ধরনের স্লিপিং ব্যাগের চাহিদা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা কিংবা বিশেষায়িত কিছু ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা আছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য এবং গবেষণা নেই উদ্যোক্তাদের। এক সময় সুইজারল্যান্ডের গুটি প্রতিষ্ঠানের উইন্টার স্লিপিং ব্যাগ উৎপাদন করত মিরপুরের অ্যাডামস অ্যাপারেলস।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল হক মুকুল জানান, স্লিপিং ব্যাগ উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামাল সাধারণ নয় বরং বিশেষায়িত। কৃত্রিম তন্তু, বিভিন্ন ধরনের পশুর লোম ও পাখির পালক ব্যবহার করা হয় কাঁচামাল হিসেবে। এসব কাঁচামাল খুব সহজলভ্য নয়। দামও অনেক। এ ছাড়া চীনের দাপটের কাছেও কুলিয়ে ওঠা সহজ নয়। চীনা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে দর প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা কঠিন।
এসি/ আইকেজে /
আরো পড়ুন:
সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে : পিআরআই