ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: আফগানিস্তানের তালেবান শাসকেরা নিজেদের মতো করে শরিয়া ভিত্তিক আইন প্রয়োগ করা শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। এর ফলে, অন্য মুসলিম দেশগুলোর তুলনায় পাকিস্তানের জন্যই বিরাট চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তালেবান।
তবে তালেবান শাসকদের ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা পাকিস্তানি সমাজে আফগানের মতাদর্শগত ঝামেলা সৃষ্টির চেষ্টা ব্যাপারটা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। পাকিস্তান মূলত টিটিপি ও অন্যান্য তালেবান সহযোগীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে, কারণ এগুলো পাকিস্তানের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তালেবান এবং সহযোগী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানের কৌশলগত সম্প্রদায়ের উপলব্ধি পরীক্ষা করছে এবং সেইসাথে বুঝতে পেরেছে যে দেশের মাদ্রাসার সাথে তালেবানের যোগসূত্রই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মূলধন। নিষিদ্ধ টিটিপি সংগঠনের প্রধান, নূর ওয়ালি মেহসুদ, একটি সাম্প্রতিক ভিডিও বার্তায় নিশ্চিত করেছেন যে তার দল একটি জিহাদ চালাচ্ছে যার প্রচারণা করছে পাকিস্তানি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা।
ইসলাম সম্পর্কে তালেবানদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মুসলিম দেশগুলো চিন্তিত হয়ে রয়েছে। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিম সমাজ স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের আধুনিক মূল্যবোধের সাথে কার্যকরী সামঞ্জস্যতা গড়ে তুলেছে। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশনসহ অনেক মুসলিম দেশ এবং গোষ্ঠী আফগান তালেবানদের মহিলাদের শিক্ষার অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে নিন্দা প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে তালেবান নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাদের নীতিগুলো ইসলামী আইনশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে গঠিত। যদিও ওআইসি তালেবান শাসনের সাথে তার সম্পৃক্ততার নীতি ত্যাগ করেনি, তবে কাবুল যদি তার আদর্শিক প্রচারণা চালিয়ে যায় তবে এটি তার পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
জাতীয়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে, ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ভবনে পাইঘাম-ই-পাকিস্তান নামে একটি ঘোষণা চালু করা হয়। ঘোষণাটির নথির প্রথম অংশে আদর্শিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ প্রদান করে একটি প্রস্তাবনা রয়েছে। দ্বিতীয় অংশে ধর্মীয় নীতিমালা সংযোজিত রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৮২৯ জন ধর্মীয় ব্যক্তি এতে স্বাক্ষর করেন। এটি দেশের সমস্ত ধর্মীয় চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করে। এ ঘোষণায় সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং জোর করে নিজের আদর্শ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো কাজের নিন্দা করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী ধর্মীয় ব্যক্তিরাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য অনুকূল পরিবেশ অর্জনের লক্ষ্যে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য, সহনশীলতা, সম্প্রীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সমাজের জন্য কাজ করবেন। ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে, পাইঘাম-ই-পাকিস্তান দাবি করে যে, ইসলামি শিক্ষা ও নীতি অনুসারে সর্বোচ্চ আইন চালু হয়েছে।
মজার বিষয় হল, আফগানিস্তান এবং ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে জিহাদকে সমর্থনকারী উলেমাসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি সংগঠনের কয়েকজন প্রধানও এতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
টিটিপি প্রধান নুর ওয়ালি মেহসুদ ভিডিও বার্তায় পাকিস্তানি ধর্মীয় ব্যক্তিদের প্রাক-পাইঘাম-ই-পাকিস্তান ফতোয়া ও মাদ্রাসায় টিকে থাকা সাধারণ জিহাদপন্থী অবস্থাকে বুঝায়। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, টিটিপি জিহাদ পাকিস্তানি ওলামাদের দেওয়া ফতোয়াগুলোর আলোকেই শুরু হয়েছিল।
ভিডিও বার্তাটি প্রকাশের আগে, পাকিস্তানি ওলামাদের একটি দল, পাইঘাম-ই-পাকিস্তানের আদলে অপর একটি ফতোয়া জারি করে। তারা ঘোষণা করে যে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জিহাদ ঘোষণা করার অধিকার নেই। জিহাদ ঘোষণা করার অধিকার শুধুমাত্র রাষ্ট্রের। এই ধরনের যুক্তির মোকাবিলা করার জন্য, টিটিপি সংগঠনের কাঠামো পরিবর্তন করছে, জঙ্গি গোষ্ঠীকে ‘উইলায়া’ (সরকার) তে রূপান্তরিত করছে এবং উপজাতীয় জেলাগুলোর জন্য একটি সমান্তরাল শাসন ব্যবস্থা গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।
তালেবান এবং টিটিপি আরও যুক্তি দেয় যে, দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে তারা তাদের মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করেছিল এবং মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে চূর্ণ করেছিল ও ন্যাটো বাহিনীকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল।
ধর্মীয় পণ্ডিতদের অবশ্যই এখন টিটিপি-এর চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হবে। নিরাপত্তা সংস্থাকে সেই আদর্শিক ধারণাটিও পর্যালোচনা করতে হবে যার উপর তার কৌশলগত চিন্তাভাবনা মূলত নির্মিত। রাষ্ট্র অনেকবার ওলেমাদেরকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এ পদ্ধতি মূলত কোনও কাজে আসেনি।
ধর্মীয় পণ্ডিতেরাই এখন টিটিপির বক্তব্যের পালটা জবাব এবং তালেবানদের ইসলামের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সাহায্য করতে পারেন।
তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। প্রথমে, এর জন্য পাকিস্তানি ওলামাদের অধিক পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন, কারণ শুধু ফতোয়া ও ঘোষণা দিয়েই এ সমস্যার সমাধান হবে না। মুসলিম বিশ্বের আলেমদের অভিজ্ঞতা থেকে ওলামারা শিক্ষা নিতে পারেন। তবে, তারা কাজটি গুরুত্ব সহকারে নিতে প্রস্তুত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।