ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: পাকিস্তানকে নিয়ে টুইটারে ব্যাপকভাবে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, লাল শার্ট ও কালো জিন্স পরা একটি ছেলে লাঠি ও ঢাল বহনকারী নিরাপত্তা কর্মীদেরকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারছে। সৈন্যরা পাথর ছুঁড়ে এর পালটা জবাব দিলে ছেলেটি পালিয়ে যায়। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, নিরাপত্তা কর্মীরা এক জেলেসন্তানকে মারধর করে রাস্তায় টেনে নিয়ে যায়।
পাকিস্তানের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশ বেলুচিস্তানের একটি বন্দর শহর গোয়াদরে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পর থেকে এই দুটি সহিংস ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিক্ষোভ সহিংস রূপ নেওয়ার আগে ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে, গোয়াদর বন্দরের প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে একটি অবস্থান বিক্ষোভ চলছিল, যার ফলে পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। হক দো তেহরিক (গোয়াদার রাইটস মুভমেন্ট) দ্বারা এই অবস্থানটি অনুষ্ঠিত হয়, যা বিগত কয়েক বছর ধরে শহরে একটি জনপ্রিয় কর্মী আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) এর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে গোয়াদর। তাছাড়া চীনের রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভুক্তও এ প্রদেশটি। কিন্তু এখানকার জনগণদের দাবি তারা নিজেদের অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে।
মাওলানা হিদায়াত উর রহমানের নেতৃত্বে, বিক্ষোভকারীরা গোয়াদর ইস্ট বে এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে। নির্মাণাধীন নিউ গোয়াদর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরেও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।
বিক্ষোভকারীরা নদীতে অবৈধ ট্রলিং বন্ধের দাবি জানায়। এদের জন্য মাছ ধরাই আয়ের একমাত্র উৎস। অন্যান্য দাবিগুলোর মধ্যে ইরানের সাথে অনানুষ্ঠানিক আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের উপর বিধিনিষেধ শিথিল করা, এলাকায় নিরাপত্তা চেকপয়েন্ট হ্রাস করা এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল, হাসপাতাল এবং বিদ্যুৎ লাভ অন্তর্ভুক্ত।
যতক্ষণ না রেহমান গোয়াদর বন্দরের প্রধান প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেন এবং চীনা নাগরিকদের বন্দর শহর ছেড়ে চলে যেতে বলেন ততক্ষণ পর্যন্ত অবস্থানটি শান্তিপূর্ণই ছিল। কিন্তু রেহমান ও তার অনুসারীরা এক পর্যায়ে অস্ত্র নিয়ে হাজির হয় এবং তাদের দাবি পূরণ না হলে সশস্ত্র প্রতিরোধের হুমকি দেয়।
গত কয়েক দশকে গোয়াদরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন এ উন্নয়ন তাদের কোনও উপকারে আসেনি। জেলে সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের মনে হচ্ছে তারা নিজেদের এলাকাতেই বহিরাগত হয়ে উঠছে। উপকূলীয় শহরে নির্মাণ ও বিনিয়োগ নাগরিকদের জীবন উন্নত করার পরিবর্তে তাদের জন্য দুর্দশা ডেকে এনেছে।
গোয়াদরের একজন সাংবাদিক এবং বিশ্লেষক, বেহরাম বালুচ বলেন, হক দো তেহরিক শুরু হওয়ার আগেও গোয়াদরে অনেক সমস্যা ছিল। এর মধ্যে একটি সমস্যা হলো নিরাপত্তা চেকপয়েন্টগুলোতে স্থানীয়দের উপরেই সন্দেহ করা হতো।
তাছাড়াও জেলেরা বিভিন্ন সমস্যা সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়, এমনকি তাদের মাছ ধরার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত ঠিক করে দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে বিশুদ্ধ পানীয় জলের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের।
বেআইনি ট্রলিংয়ে মাছ ধরা জেলে সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিবেশী সিন্ধু এবং অন্যান্য প্রদেশ থেকে ট্রলারগুলো গোয়াদরে মাছ ধরতে আসে। পাকিস্তান সরকার চীনা ট্রলারগুলোকে উপকূলের অদূরে মাছ ধরার লাইসেন্স দিয়েছে। ফলে স্থানীয়রা, তাদের ছোট নৌকায়, ভাল সজ্জিত চীনা প্রতিযোগীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে অক্ষম।
গোয়াদরের বাসিন্দাদের হতাশা কোনও নতুন বিষয় নয়। এত বছরের এত হতাশা জমতে জমতে তা এখন বিক্ষোভের রূপ লাভ করেছে।
সামাজিক কর্মী এবং গোয়াদরের গ্রামীণ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি, নাসির রহিম সোহরাবি জানান, গোয়াদরে বেকারত্ব, অবৈধ ট্রলিং, সীমান্ত ব্যবসা সমস্যার মতো নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে।
সরকার শুধু বলেই যাচ্ছে গোয়াদরের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু এ উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কোন উপকারেও আসছে না। প্রকল্পগুলো থেকে কোনও উপকারই সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না।
বেহরাম বালোচ জানান, জেলা প্রশাসন দাবি করে যে, স্থানীয়দের অনেক প্রাথমিক দাবি পূরণ করা হয়েছে। যেমন, চেকপয়েন্ট বিলুপ্ত করা হয়েছে, অবৈধ ট্রলিং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং জনগণকে সীমান্ত বাণিজ্যে সহায়তা করা হয়েছে। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো অল্প সময়ের জন্য নেওয়া হয়েছিল এবং তারপর সবকিছু আবার আগের মতোই চলছে।
২৭ অক্টোবর, ২০২২ -এ, রেহমান এবং তার সমর্থকরা সরকারকে তার প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এনে আরেকটি অবস্থান শুরু করে।
ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এই অনশন চলতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর, হাজার হাজার মহিলা রেহমানের সমর্থনে গোয়াদরে সমাবেশ করেন। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
রেহমান গোয়াদর বন্দরে কর্মরত চীনা নাগরিকদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য একটি সতর্কতা জারি করে, গোয়াদরে সমস্ত সিপিইসি প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্য বলেন।
কিন্তু সরকার ও আন্দোলরত নেতাদের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার একদিন পর ২৭ ডিসেম্বর পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। রেহমানের ধর্মঘটের ডাকে সাড়া দেওয়া বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।
হক দো তেহরিক-এর অন্যতম সাফল্য হল নারীদের একত্রিত করা। অন্যথায় রক্ষণশীল সমাজে যেখানে নারীরা তাদের ঘরে সীমাবদ্ধ, হক দো তেহরিক নারীদের তাদের অধিকারের জন্য প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করতে এবং নেতৃত্ব দিতে উৎসাহিত করতে পেরেছে। কিন্তু বিক্ষোভ যখন হিংসাত্মক রূপ নেয়, তখন নারীরাও পুলিশদের দ্বারা নির্যাতিত হয়।
এ ব্যাপারে গোয়াদরের বাসিন্দা,নাজিয়া জান মুহাম্মদ বলেন, যখন পুলিশেরা পুরুষ বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালায়, তখন মহিলারা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে পুরুষদেরকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে।
তবে নারীসহ সবার ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ।
৭০ বছর বয়সী কবি, মাসি জয়নব, ২০২১ সালে বিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিলেন এবং তারই আহ্বানে রেহমান প্রাথমিক বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি ২০২২ সালের বিক্ষোভেও অংশ নেন।
বিক্ষোভের ঘটনায় ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। এরপর শতাধিক বিক্ষোভকারীদেরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। স্থানীয় সাংবাদিক হাজী ওবায়দুল্লাহকে সংঘর্ষের ভিডিও তোলা এবং রিপোর্ট করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়।
হক দো তেহরিক-এর আটক নেতাদের মধ্যে রয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হুসেন ওয়াদিলা, ইয়াকুব জোস্কি এবং শরীদ মিয়াঁদাদ। আন্দোলনের প্রধান রেহমানরের বিরুদ্ধেও একটি এফআইআর দায়ের করা হয়। কিন্তু বিক্ষোভ শেষ হওয়ার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন।
তবে গত সোমবার, রেহমান টুইটারে ঘোষণা করেন যে তিনি গোয়াদরে ফিরে যাচ্ছেন।
কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, এই আন্দোলনটি সম্পূর্ণরূপে গোয়াদরের বাসিন্দাদের অধিকারের জন্য নয় বরং রেহমান এবং গোয়াদরের প্রাদেশিক পরিষদের বর্তমান সদস্য হাম্মাল কলমাতির মধ্যে একটি স্থানীয় রাজনৈতিক যুদ্ধ।
সোহরাবী বলেন, হক দো তেহরিকের দাবি জনগণের দাবি, কিন্তু রেহমানের সুর সবসময় রাজনৈতিক ছিল। তিনি সব সময় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছাই প্রকাশ করেন। জনগণের সমর্থন থাকায় তিনি উপনির্বাচনে জয়ীও হয়েছেন।
জনগণের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি আন্দোলনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও এর বেশিরভাগ অনুসারীদের মতে, হক দো তেহরিক কেবল একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।