ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: বান্নু অঞ্চলে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) কর্তৃক পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা এবং ইসলামাবাদের আই-১০ সেক্টরে গত রবিবারের একাধিক হামলার ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, নভেম্বরে টিটিপি পাকিস্তান সরকারের সাথে যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহারের পর থেকেই দেশে সন্ত্রাসী হামলা বেড়েছে।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং পিটিআই চেয়ারম্যান, ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পর গত আট মাসে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশটির অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), দায়েশ বা আইএস এবং বালুচ বিদ্রোহীসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীরা তাদের প্রতিদিনকার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
পাকিস্তানি বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকদের মতে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য দেশকে ধ্বংসের মুখে ফেলতেও রাজি ইমরান খান। আজীবনের জন্যে না হলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান তিনি। এর জন্য যা যা করা প্রয়োজন তিনি সেটাই করবেন।
ইমরান-ফয়েজ জুটি নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল অসীম মুনিরের নিয়োগ আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নতুন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর টিটিপি সন্ত্রাসীরা, যারা ইমরান-ফয়েজের অত্যন্ত প্রিয়, তারা খাইবার পাখতুনখোয়া, বেলুচিস্তান, ইসলামাবাদ এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ব্যাপক হারে হামলা চালায়।
পাকিস্তান বর্তমানে গুরুতর সন্ত্রাসী হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিসেম্বর ১৯- ২১ পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা বান্নু অঞ্চলকে জিম্মি করে রেখেছিল। ২৩ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে একজন মহিলা ও দুই আত্মঘাতীর দ্বারা হামলার ঘটনায় একজন পুলিশ নিহত হয় এবং ছয়জন গুরুতরভাবে আহত হয়।
২১ ডিসেম্বর, ২৫ জন জঙ্গি নিহত, তিনজন আটক এবং সাতজনের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বান্নু অভিযান শেষ হয়।
পাকিস্তানি বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকরা কেপিকে সরকারের উদাসীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, কেপিকে সরকার নিজ অঞ্চলের সুরক্ষার দিকে মনোযোগ না দিয়ে ইমরান খানকে খুশি করা এবং তার ইশারায় রাজনীতির এক নতুন খেলায় মেতেছেন।
সমস্ত সম্পদ জার্মান পার্ক বা বনি গালায় সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কেপিকে-এর সিএম, মাহমুদ খান তার মন্ত্রিপরিষদ এবং পিটিআই নেতাদের সাথে সে সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন।
কিছু কিছু নাগরিক ইতিমধ্যেই টিটিপি-এর পুনরায় সক্রিয় কার্যক্রমের কাছে সরকারের কাছে জবাবদিহি চাইছেন। তালাত হোসেনসহ বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবেলার জন্য সামরিক সংস্থাকে খোলাখুলিভাবে সরকারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
অপর একজন সাংবাদিক, আজাজ সৈয়দ ইসলামাবাদে আত্মঘাতী হামলার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন যে, ইসলামাবাদ পুলিশ কয়েক দিন আগেই ইসলামাবাদে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে হুমকি সতর্কতা জারি করেছিল।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মেরুকরণের অবসান ঘটলেই সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। তিনি জানান যে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানে আত্মঘাতী হামলার পরিমাণ আরো বৃদ্ধির জন্য টিটিপি আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করেছে।
পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসী হামলা সীমিত পরিসরে হচ্ছে এবং একটি নতুন সামরিক অভিযান চলমান। এ বছর দেশে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।
টিটিপি ৯২৫টিরও বেশি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। অপরদিকে ৩১ টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে দায়েশ। উল্লেখিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ৯৫ শতাংশই ঘটেছে খাইবার পাখতুনখোয়ায়। এ ঘটনাগুলোতে, ১১০ জনেরও বেশি পুলিশ, ৯০-৯৫ জন নিরাপত্তা কর্মী, প্রায় ২৩৫ জন সাধারণ নাগরিক ও সরকারপন্থী মানুষ এবং ২১০ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।
ইসলামাবাদের ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় তালেবান সমস্যা এবং ইসলামপন্থী বিশেষজ্ঞ সেলিম সাফি বলেছেন যে, ইসলামাবাদে হামলার ঘটনার পর পাকিস্তানের বুঝা উচিত যে সন্ত্রাসী হামলা শুধু কেপিকেতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
সরকার, সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি দেশের এই বিপদ অনুধাবন না করতে পারে, তবে দেশটির মানুষ আবার ২০১৪ সালের পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।
তিনি বলেন যে, এটা এখন স্পষ্ট যে, পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকরা আফগান তালেবান এবং টিটিপি সম্পর্কে তাদের ধারণা ও ইচ্ছার ভিত্তিতেই একটি নীতি তৈরি করেছিল এবং ডানপন্থী দল, পিটিআই এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা এই নীতির এতো প্রচার করেছিলেন যে, পাকিস্তানি জনগণও তাদের এ নীতি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। তারা বলেছিল, টিটিএ এবং টিটিপি এর কোন পারস্পরিক যোগসূত্র নেই। টিটিপি তৈরি করেছে রো এবং আফগান গোয়েন্দা সংস্থা। এমনকি কেউ কেউ মার্কিন ড্রোন হামলায় টিটিপি-এর সকল আমীর নিহত হয়েছে তা উপেক্ষা করেই এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে।
পাকিস্তানিদের বুঝানো হয়েছিল যে, পাক-বান্ধব আফগান তালেবানেরা আফগানিস্তানে সফল হওয়ার সাথে সাথেই টিটিপি এর মতো সংগঠন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই কারণেই পাকিস্তানই একমাত্র এমন দেশ যেখানে আফগানিস্তান তালেবানদের দখলে আসা নিয়ে আনন্দ উদযাপন করা হয়েছিল।
পাকিস্তান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, ইমরান খান ঘোষণা করেছিলেন যে, আফগানরা দাসত্বের শিকল ভেঙ্গে দিয়েছে।
পাক নীতিনির্ধারকেরা কোনো সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টাও করে না বা মূলোৎপাটনের চেষ্টাও করে না। টিটিপি এর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে। টিটিপিকে হয় সাময়িকভাবে সামরিক অভিযানের দ্বারা দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে নতুবা সমস্ত দায় আফগানিস্তানের উপর ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন ড্রোনের দ্বারাই টিটিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পাক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে টিটিপির কোন ক্ষতিই করা যায় নি। মাওলানা নেক মুহাম্মাদ, বাইতুল্লাহ মেহসুদ, হাকিমুল্লাহ মেহসুদ এবং মাওলানা ফজলুল্লাহ সহ সমস্ত শীর্ষ টিটিপি কমান্ডার ড্রোন হামলায় নিহত হন। ড্রোনের কারণেই টিটিপি নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন কিংবা এক জায়গায় জড়ো হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন ক্ষমতা প্রত্যাহারের পর, টিটিপি আবার শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
আফগান ও পাক তালেবানরা অভিন্ন মতাদর্শ ও বিশ্বাস বহন করে। জিহাদ এবং কিতাল (যুদ্ধ/হত্যা) সম্পর্কে তাদের ধারণা একই। পাক তালেবানরা তাদের আফগান সমকক্ষদের সমর্থনে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। যখন তারা দেখল যে আফগান তালেবানরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো এর মতো শক্তিকে পরাজিত করেছে, তখন টিটিপি এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর মনোবল শক্তিশালী হয়ে উঠে।
টিটিপি বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি তালেবানরা আবদুল ওয়ালি খালিদ খুরাসানির নেতৃত্বে জামাতুল আহরার নামে একটি পৃথক দল গঠন করে। হাফিজ সাইদ এবং অন্যান্যরা দায়েশে যোগ দেয়।
কয়েকদিন আগে, মাজার বালুচের নেতৃত্বে বেলুচিস্তানের মাকরান বিভাগের একটি জঙ্গি গোষ্ঠী মুফতি নূর ওয়ালীর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করে।
অন্যদিকে, ইমরান খান সরকারের আমলে এ বিষয়ে কোন গুরুত্বই দেওয়া হয় নি। বর্তমান সরকারও এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব প্রদান করেন নি। গত বছরের পর এমন কোন দিন যায় নি যখন কেপিকেতে কোন সন্ত্রাসী হামলা হয় নি।
কয়েক বছর ধরে, পাকিস্তানি তালেবানরা কুনার, নুরিস্তান, পাকতিয়া, নানগারহার এবং খোস্ত প্রদেশের গুহা ও পাহাড়ে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে তুলেছে কিন্তু কাবুলের পতনের পর, পুরো আফগানিস্তানই তাদের দখলে চলে আসে। তারা এখন একসঙ্গে বসতে পারে, আলোচনা করতে পারে এবং পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। তালেবানের একটি বড় শক্তি উপজাতীয় জেলা এবং সোয়াতের মতো এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের পর, টিটিপি-এর সম্পদ অভূতপূর্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা সবচেয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও হাতে পেয়েছে।
ডিজি আইএসআই স্তরে টিটিপির সাথে একটি সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ফেডারেল স্তরে সরকার পরিবর্তনের পর দেখা যায় যে সংলাপের বিষয়টি কোর কমান্ডার পেশোয়ার এবং কেপিকে সরকারের সাথে হয়েছিল, যখন ফেডারেল সরকার নীরব দর্শক হিসেবে ছিলেন।
এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, এফএম এবং মাওলানা ফজলুর রহমানের মতো সরকারী কর্মকর্তাদের এ বিষয়ের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ নেই।
সংক্ষেপে, পাকিস্তানের শাসক ও রাজনৈতিক শ্রেণী এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে খুব হালকাভাবে নিচ্ছেন। এর জন্য বিভিন্ন সরকার ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বাত্মক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং ঐকমত্য প্রয়োজন।