ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: ২০১৭ সালের শেষ দিক থেকেই চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর এবং কাজাখ অভিবাসীরা তাদের পরিচিতদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জানা যায়, ১৯৪৯ সাল থেকেই চীনা সরকার জিনজিয়াং প্রদেশ, যা অনেকের কাছে পূর্ব তুর্কিস্তান নামেও পরিচিত, এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ উইঘুর জাতিসহ, তুর্কি জাতিগোষ্ঠীকে তাদের শিবিরে আটকে রাখতে শুরু করে। শিবিরে দশ থেকে বিশ লাখের মতো বন্দি ছিল, যাদের প্রতিনিয়ত শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।
বেইজিং প্রথমে “কেন্দ্রীভূত শিক্ষাগত রূপান্তর কেন্দ্র” এর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল। তবে সরকারি কর্মকর্তারা পরবর্তীতে “বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র” প্রতিষ্ঠানের কথা স্বীকার করে, এবং দাবি করে যে এ কেন্দ্র চরমপন্থার অবসান করবে ও দারিদ্র্য দূর করতে সাহায্য করবে।
তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে তাদের গণহত্যার ঘৃণ্য সত্য বিশ্ববাসীর সম্মুখে উন্মুচিত হলে এ শিবিরগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের উপর আসা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে বিশ্ববাসীর ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০১৯ সালে কর্তৃপক্ষ অনেক বন্দিকেই শিবির থেকে সরিয়ে দেয়।
তবে মূলত বেশিরভাগ বন্দিকেই মুক্তি দেওয়া হয়নি। অনেক শিবিরকে কেবল আনুষ্ঠানিক কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং বন্দিদেরকে দীর্ঘ কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ বন্দিকে দেশের অন্য কোনও শিবিরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেসব উইঘুরেরা দেশে ফিরতে পেরেছেন তারা গৃহবন্দী জীবনযাপন করছেন এবং শিবিরে বন্দিরত উইঘুরদেরকে জোরপূর্বক দাস বানিয়ে রাখা হয়েছে।
চীনা সরকার উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে, তাদের মসজিদ, মাজার এবং কবরস্থান ধ্বংস করা হয়েছে।
উইঘুর মহিলাদেরকে জোরপূর্বক হান অধিবাসীদের সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে চীনা ভাষা এবং হান সংস্কৃতি শিখতে বাধ্য করা হচ্ছে। যেসব শিশুরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি লালন করতে চাচ্ছে তাদেরকে মারধোর করা হচ্ছে।
চলমান নিপীড়ন সত্ত্বেও, বিশ্ব গত কয়েক বছরে জিনজিয়াংয়ের নৃশংসতার দিকে খুব কমই মনোযোগ দিয়েছে। চীনের দিকেও বিশ্বের মনোযোগ ফিরেছে শুধু কোভিড-১৯ এর জন্য। বেইজিং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করতে সক্ষম হয়, শুধু গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতীকী প্রতিবাদের মাধ্যমে। নৃশংসতা চীনের নেতা শি জিনপিংকে ঐতিহাসিকভাবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য সিসিপির প্রধান হিসেবে মনোনীত হওয়া থেকে বা ঘনিষ্ঠ অনুগতদের সাথে পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটি গঠন হওয়াকে থামাতে পারেনি। এটি তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিদেশী নেতাদের সাথে দেখা করতেও বাধাপ্রদান করেনি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, শি জিনজিয়াং তার নৃশংস কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে রয়েছেন। কিন্তু মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞাগুলোর মাধ্যমে চীন বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে রয়েছে। ধারণা করা যায়, বিশ্ব যদি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে চীনের উপর চাপ বজায় রাখে তাহলে হয়তো একদিন চীন এই আদিবাসীদের উপর অন্যায় আচরণ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখবে।
জিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবিরের খবর যখন প্রথম ছড়িয়ে পড়ে, তখন পুরো বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে ছিল তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য, যদিও যুক্তরাষ্ট্র তখন তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সাংবাদিক এবং কিছু সংখ্যক গবেষক চীনের নৃশংসতা তুলে ধরলেও অধিকাংশ বিশ্বনেতারাই তখন চুপ ছিলেন। তখন মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভেন মুচিন একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বেইজিংয়ের সাথে তার আলোচনাকে বিপর্যস্ত করতে চাননি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল করে বসেছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি শি কে সমর্থন জানিয়ে সর্বসম্মুখে বলেছিলেন এই শিবিরগুলো একদম যথার্থ কাজ করছে।
এত কিছুর পর, প্রশাসন শেষ পর্যন্ত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং বিশ্বব্যাপী ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞার জন্য জিনজিয়াংয়ের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এবং সত্তাকে তালিকাভুক্ত করে এবং কংগ্রেস অবশেষে ২০২০ সালে উইঘুর মানবাধিকার নীতি আইন পাস করে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, বাইডেন একটি নতুন, শক্তিশালী নিষেধাজ্ঞা আইন-উইঘুর ফোর্সড লেবার প্রিভেনশন অ্যাক্ট-এ স্বাক্ষর করেন- যা জিনজিয়াং-এ উৎপাদিত যেকোনও পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে। এখন পর্যন্ত, চীনা কোম্পানি, সরকারী সংস্থা এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ১০০ টিরও বেশি জিনজিয়াং-সম্পর্কিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
অন্যান্য দেশের সরকারও পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগদান করে। বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, লিথুয়ানিয়া এবং নেদারল্যান্ডস, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে সিসিপির জিনজিয়াং কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসাবে নিন্দা করে।
২০১৮ সালের আগস্টে, জাতিসংঘের জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ কমিটি চীনা কর্মকর্তাদের প্রথমবারের মতো জিনজিয়াং-এ কী ঘটছে তা প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করতে বাধ্য করে। তবে পরবর্তীতে জাতিসংঘ চীনাদের বিরুদ্ধে আর গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। বাইশটি দেশ (১৮টি ইউরোপীয় দেশ এবং অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান এবং নিউজিল্যান্ড) জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে একটি চিঠিতে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের বর্বরতার কথা জানালে, চীন দ্রুত ৩৭টি রাজ্যকে একত্রিত করে পাল্টা একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা করে যে জিনজিয়াংয়ে সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে চলছে৷
গত জুনে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ১৯ জন সদস্য জিনজিয়াং-এ মানবাধিকার বিষয়ক পরিষদের সমালোচনামূলক প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্কের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন এবং ১১ জন সদস্য ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।
দীর্ঘ আলোচনার পর, হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট ২০২২ সালের মে মাসে জিনজিয়াং পরিদর্শনে যান। পাঁচ দিনের সফর শেষে তিনি শিবিরগুলোকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত, তিনি একটি প্রতিবেদনে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের কঠোর সমালোচনা করেন। সেখানকার মানবতাবিরোধী অপরাধের কথা উল্লেখ করে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চীন তখন এই প্রতিবেদনটিকে ভুয়া বলে অস্বীকার করে।
জিনজিয়াংয়ের অর্থনীতি এবং কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিচার করা এখনও কঠিন। আমদানি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করাও কঠিন।
জিনজিয়াংয়ে সিসিপি উপনিবেশবাদের বর্বরতা তাইওয়ানের সাথে চীনের সম্পর্কের জন্য বিশেষভাবে ধ্বংসাত্মক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, তাইওয়ানের আইনসভা উইঘুর জনগণের বিরুদ্ধে চীনের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি অভূতপূর্ব ক্রস-পার্টি রেজুলেশন পাস করে।
জিনজিয়াংয়ের স্থানীয় জনগণের উপর সিসিপির আক্রমণ অন্তত বিশ্বের উন্নত অর্থনৈতিক দেশগুলোর মধ্যে বেইজিংয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিকেও ছিন্নভিন্ন করেছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলো দীর্ঘকাল ধরে চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলো। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতিতে চীনের মতামত নাটকীয়ভাবে নেতিবাচক হয়ে পড়ে।
নীতি প্রণয়নের সময় শি একবারের জন্যেও দেশের জনগণের কথা ভাবেনি। এর থেকে এটাই বুঝা যায় যে, চীনের বর্তমান একনায়কতন্ত্রে জিনজিয়াং প্রদেশে পরিবর্তন আনতে পারেন একমাত্র শি নিজেই।
আই.কে.জে/