ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর এবং ডিসেম্বরে প্রকাশিত দুইটি প্রতিবেদনে, বিশ্বব্যাংক ২০২২ ও ২০২৩ সালে চীনা অর্থনীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এখন বিশ্বের শীর্ষে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই নয় বরং তার নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের থেকেও প্রতিযোগিতায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের দুইটি প্রতিবেদনেই বলা হয় যে, ২০২১ সালে যেখানে চীনের মোট দেশীয় পণ্যের বৃদ্ধির হার ৮.১ শতাংশ ছিল, ২০২২ সালে এসে তা ২.৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে ২০২৩ সালে এদেশ ৪.৩ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতে পারে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ সালে ভারতের জন্য এ প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ।
২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর, বেইজিং থেকে একটি এপি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে বলা হয়, চীনের উৎপাদন খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে। শূন্য কোভিড নীতির ফলে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, সেইসাথে বিরাট ধাক্কা খেয়েছে এস্টেট ব্যবস্থা। ২০২২ সালের প্রথমার্ধে, প্রবৃদ্ধির হার ২.২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২২ সালে সামগ্রিক বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশেরও কম হতে পারে। ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা এখন বেইজিংয়ের নাগালের বাইরে বলেই মনে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিনিয়োগ, কম খরচে উৎপাদন ও রপ্তানির ওপর ভিত্তি করে চীনের উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার তার সীমায় পৌঁছেছে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার দিকে পরিচালিত করেছে। এই ভারসাম্যহীনতা হ্রাস করার জন্য অর্থনীতির কাঠামোতে উৎপাদন থেকে উচ্চ মূল্যের পরিষেবা, বিনিয়োগ থেকে খরচ সবদিকেই পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে এর মাঝে কোনো ব্যবস্থাকেই চীনের ক্ষমতাসীন সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে না।
কোভিড-১৯ এর বারবার প্রাদুর্ভাবের কারণে নির্মাণাধীন বাড়িগুলোতে বিনিয়োগ করতে ক্রেতাদের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে, ফলে ধাক্কা খেয়েছে এস্টেট বাণিজ্য, যা বিরূপ প্রভাব ফেলছে চীনের অর্থনীতির উপর।
শ্রমশক্তি বৃদ্ধির হার হ্রাস, বিনিয়োগে আয় হ্রাস এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির গতি হ্রাসের মতো কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মুখে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে। অতীতে দ্রুত প্রবৃদ্ধির হার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এখন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে শূন্যতা দেখা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, চীনের জন্য একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং বাজার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন এখন সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু তা চীন সরকারের অগ্রাধিকার নয়।
বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করেছে যে, চীনা অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক আর্থিক অবস্থার কঠোরতা এবং উচ্চতর ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্যেও ঝুঁকিপূর্ণ, যার জন্য বেইজিং নিজেই সবচেয়ে বড় অপরাধী।
২০২২ সালের অক্টোবরে, চীনা অর্থনীতির উপর বিবিসির একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের জুনের ত্রৈমাসিকে, চীন অর্থনীতির প্রকৃত সংকোচনের অভিজ্ঞতা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। চীনা ইউয়ানের মূল্য মার্কিন ডলারের বিপরীতে হ্রাস পেয়েছে, ফলে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা কমে গিয়েছে।
শূন্য-কোভিড নীতি যা অবশেষে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তুলে ফেলা হয়, তা ইতিমধ্যেই শেনজেন এবং তিয়ানজিনের মতো উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে প্রভাব ফেলেছে। বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কারখানার উৎপাদন ব্যাপক হারে কমেছে। লোকেরা আর খাদ্য, পানীয়, খুচরা বা পর্যটনে ব্যয় করতে চাইছে না।
প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির চাপের মুখে চীন সরকার এস্টেট খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এখন এস্টেট ব্যবস্থার চাহিদা এতোটা কমে গিয়েছে যে, রিয়েল এস্টেট সংস্থাগুলো তাদের ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম।
তাছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশ চীন, যা দেশটির অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সিয়াচেন এবং চংকিং এর মতো জায়গাগুলোতে শিল্প প্রতিষ্ঠান জলবিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে এ এলাকাগুলোতে খরা দেখা দিয়েছে এবং উৎপাদন হারও হ্রাস পেয়েছে। আইফোন নির্মাতা ফক্সকন এবং টেস্টা বিদ্যুতের স্বল্পতার জন্য কাজের সময় কমাতে বা কাজ পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
বিবিসি সমীক্ষায় আরও দেখা যায় যে, টেনসেন্টের মুনাফা ৫০ শতাংশ কমেছে এবং আলিবাবার নেট আয় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। চীনে কয়েক হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশের মতো।
শি জিনপিং সরকারের অন্যতম দিকনির্দেশক নীতি হলো ২০২১ সাল থেকে পরিচালিত “মধ্যম সমৃদ্ধি প্রচারাভিযান”, যা সকলের মধ্যপন্থী সমৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। কিন্তু এর বাস্তবিক প্রয়োগ খুব কমই দেখা যাচ্ছে।
আইকেজে/