spot_img
32 C
Dhaka

২৬শে মার্চ, ২০২৩ইং, ১২ই চৈত্র, ১৪২৯বাংলা

কোটি শিশুর প্রদীপ হয়ে থাকবে শেখ রাসেল

- Advertisement -

তাপস হালদার :: ১৮ অক্টোবর। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িকে আলোকিত করে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার আদরের ছোট সন্তান হিসেবে যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিল তার নাম রাসেল। দীর্ঘ সাত বছর পর পরিবারে নতুন অতিথি এসেছিল বলে সবার মধ্যেই সে কি আনন্দ! তখন পিতা বঙ্গবন্ধু বাড়িতে ছিলেন না। রাজনৈতিক প্রোগ্রামে চট্টগ্রাম ছিলেন। রাসেল নামকরণের সাথেও একটি ইতিহাস আছে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বই পড়ার প্রতি প্রচন্ড নেশা ছিল। লেখক দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের বই তিনি প্রচুর পড়তেন এবং তর্জমা করে বেগম মুজিবকে শুনাতেন। বাবা মুজিব হয়তো সন্তানের মুখ দেখে অনুমান করেছিলেন- আমার এই সন্তান একদিন আপন প্রতিভায় দীপ্ত হয়ে উঠবে। হবে কোনো লেখক, দার্শনিক কিংবা বিশ্ব শান্তির নতুন কোনো কান্ডারী। শহীদ রাসেলের স্বল্প জীবন বিশ্লেষণ করলে আমরা সেটাই দেখতে পাই। সে ছিল প্রচন্ড সাহসী, মানবিক ও রাজনৈতিক বোধ সম্পন্ন।

রাসেলের যখন দেড় বছরের কিছু বেশি বয়স তখন বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করেন এবং পাকিস্তান সরকার তাঁকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। রাসেল প্রথম বারের মতো তখন মায়ের সাথে কারাগারে পিতাকে দেখতে যায়। বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি দুই বছরের কম বয়সী ছেলে এসে বলে আব্বা বালি চলো। কী উত্তর দেবো ওকে? ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ওতো বুঝেনা আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম তোমার মার বাড়ি তুমি যাও, আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো । ও কি বুঝতে চায়। কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা তার আদরের ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা‘ বই থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘আব্বার সাথে প্রতি ১৫ দিন পর পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলেও আর আসতে চাইতো না, খুব কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে আব্বার বাসা জেলখানায়। আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা আমাদের বাসায় চলে যাব বেশ কষ্ট করে ওকে নিয়ে নিয়ে আসতে হতো। আর তখন আব্বার মনের অবস্থা যে কি আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায়ও আব্বার জন্য কান্না করলে মা ওকে বোঝাতো, আমিই তোমার আব্বা। আমাকেই আব্বা বলে ডাকো, পরে মাকেও আব্বা বলে ডাকতো। একদিন বললো হাসু আপা তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলে ডাকি।’

রাজনৈতিক সচেতনতার কথাও আমরা জানতে পারি, ছোট্ট রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে মা আব্বার কাছে যাবে না? মা কোনো উত্তর দেয় না। দিবে কি করে তখন যে ছয় মাস ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা হয়েছিল। কেউ কোনো খবরই জানতো না কোথায় আছে। ছেলেকে শুধু বুকে টেনে নিয়ে আদর করলো মা। রাসেল আবার জিজ্ঞাসা করলো মা আব্বার নাকি ফাঁসি হবে? মা ফাঁসি কি? মা বললেন তোমাকে একথা কে বলেছে। রাসেল উত্তর দেয় সেদিন কাকা, দুলাভাই আর কামাল ভাই বলেছিল আমি শুনেছি মা। এমনই রাজনৈতিক সচেতন ছিল রাসেল। বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে জয় বাংলা স্লোগান দিত। এমনকি হরতালের দিনে বাসার সামনের লনে দাঁড়িয়ে হরতাল হরতাল বলে সেøাগান দিত।

রাসেল পিতার সান্নিধ্য বেশি না পেলেও যখন পেতো তখনই বঙ্গবন্ধুকে সবসময় অনুকরণ ও অনুসরণ করতো। জামা-জুতা হাঁটার স্টাইলসহ সব কিছুই অনুকরণ করতো। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পোশাক ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি। সেজন্য রাসেলেরও ছোট লুঙ্গি ছিল। বঙ্গবন্ধুর চশমাটাও মাঝে মাঝে নিজের চোখে নিয়ে মজা করতো।

একদিন বঙ্গবন্ধু বন্যা দুর্গতদের দেখতে পায়জামা পাঞ্জাবির সাথে জুতা পরে বের হচ্ছেন দেখে একজোড়া স্যান্ডেল এনে দিলো। তখন পিতা বললেন, কাদামাটিতে হাঁটতে হবে বাবা। তখন রাসেল বলল, আরেক জোড়া সঙ্গে নিয়ে যাও।

বঙ্গবন্ধুও যখনই সময় পেয়েছেন তখনই রাসেলকে সময় দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন বিভিন্ন দেশ সফরে রাসেলকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।

রাসেল খুবেই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতো সবসময়। তাঁর প্রিয় ছিল সাইকেল। দুটো সাইকেল একটি লাল, অন্যটি নীল রংয়ের। এখনও সাইকেল দুটো বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অন্য একটি গুণ ছিল আতিথেয়তা। যে শিক্ষয়িত্রী তাকে পড়াতেন তাঁর জন্য প্রতিদিন দুটো মিষ্টি বরাদ্দ ছিল। তিনি খেতে না চাইলে বই পড়তো না। আতিথেয়তা বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।

রাসেলের মৃত্যুর দিনটিও পিতার আদর্শে উজ্জ্বল হওয়ার কথা ছিল। সমাবর্তন উপলক্ষ্যে ১৫ই আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট জানানোর জন্য ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষ থেকে বাছাই করা হয়েছিল ৬জন সদস্যকে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শেখ রিসাল উদ্দিন (রাসেল)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তার আর স্যালুট জানানো হয়নি।

সেদিন যদি শেখ রাসেল শহীদ না হতেন তাহলে আজ ৫৫ বছরে পদার্পণ করতেন। তাহলে নিশ্চয়ই তার প্রিয় হাসু আপার সাথে থেকে বাংলাদেশ বিনির্মাণের পক্ষে কাজ করতেন, নেতৃত্ব দিতেন দেশ জাতি সমাজ গঠনে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হারিয়েছেন তার আদরের সবচেয়ে প্রিয় ছোট ভাই কে আর বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান সন্তানকে। শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণের কাছে ভালবাসার নাম। একটি নিষ্পাপ শিশু হিসেবেই চিরকাল থাকবে। মানবিক চেতনাবোধ সম্পন্ন বিবেকবান মানুষেরা শহীদ শেখ রাসেলের বেদনার কথা হৃদয়ে ধারণ করে চিরদিন শিশুদের জন্য কাজ করে যাবেন। ইতিহাসের মহাশিশু হয়েই চিরদিন বেঁচে থাকবে প্রতিটি বাঙ্গালির হৃদয়ে।

খুনিরা তাঁকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর উত্তারাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, তাদের সে অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল সব সময় বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের সব শিশুর অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে, অবহেলিত অধিকার বঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হিসেবে। শেখ রাসেল তুমি মরনি, তুমি বেঁচে আছো কোটি শিশুর প্রদীপ হয়ে। শুভ জন্মদিন, শহীদ শেখ রাসেল।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

- Advertisement -

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফলো করুন

25,028FansLike
5,000FollowersFollow
12,132SubscribersSubscribe
- Advertisement -

সর্বশেষ