মেহের আলী :
আমার (পাকিস্তানি) দাদা, কর্নেল নাদির আলী প্রায়ই ১৯৭১ সালের স্মৃতিচারণ করতেন। ১০ এপ্রিল যখন তাকে ঢাকা পাঠানো হয় তখন তিনি ৩য় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের ২য় এবং তারপর ১ম কমান্ডে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে এনে পদোন্নতি প্রদান করা হয়।
ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার দিন, সকালবেলা তিনি তার সেনা পোশাক পরিবর্তন করে ধুতি পরেন এবং রাঙামাটি হ্রদে ঘুরতে যান। সেখানে একটি ছোট নৌকায় করে তিনি ঘুরে বেড়ান এবং মাঝির সাথেই ডাল-ভাত খান। তার তখন মনে হচ্ছিল তিনি কোনও অফিসার নন, বরং একজন সাধারণ স্থানীয় বাসিন্দা। এরপর তিনি মানসিকভাবে এত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন যে তাকে ছয় মাসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তার সাময়িকভাবে স্মৃতিশক্তি চলে যায় এবং তাকে অকালেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে হয়।
আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি কি ভয় পেয়েছিলে তখন?” আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম যুদ্ধ, সহিংসতা, উন্মাদনা সব মিলিয়ে তখন তার মনের অবস্থা ঠিক কেমন ছিল। কিন্তু তিনি বললেন, তিনি ভয় পান নি। অথচ আমি তার কণ্ঠস্বরে অনুশোচনার গ্লানি বুঝতে পারছিলাম।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান শুধু একটি যুদ্ধ হারে নি, হারিয়েছিল তার শরীরের একটি অংশ। পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার জন্য ক্রমাগত অস্বীকৃতি, সেনাবাহিনীর নারকীয় নৃশংসতা, ধর্ষণ, গণহত্যা সবকিছুই প্রমাণ করে পাকিস্তানের অনৈতিকতার। পাঠ্যপুস্তকে এ বিশাল ঘটনাকে শুধুমাত্র ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে পাকিস্তান কার্যত তার ইতিহাসকেই অস্বীকার করছে। এতসব কিছু অস্বীকার করে পাকিস্তান তার অতীত ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে, যেখানে বাংলাদেশ এখনও যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
তবে পাকিস্তান যদি তার অতীত ইতিহাসকে মেনে নিয়ে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়, তবেই হয়তো সে সত্যিকারে তার অতীতের গ্লানি মুছে ফেলতে সক্ষম হবে।
আমার মাঝেমাঝে দাদার কথা মনে পড়ে। তিনি প্রথম দিকে গিয়েছিলেন ফরিদপুর। সেখানে তার সহকর্মীদের নির্মমতা ও সহিংসতা দেখে তিনি স্তব্ধ হয়ে যান। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো বাঙালিদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে এবং হিন্দুদেরকে গুলি করে মেরে ফেলতে অথবা বিতাড়িত করতে। কিন্তু তিনি বলেছিলেন যে তিনি হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করবেন না এবং নিরস্ত্রদের উপর গুলিও চালাবেন না।
তখন তার সহকর্মীরা রাগান্বিত হয়ে তাকে বলেছিল, “তুমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে তোমার বাঙালি বন্ধুদের সাথে আনন্দ করতে আসোনি। তুমি জানোই না এখানে কী হচ্ছে।”
সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পাশাপাশি তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনারও ব্যবস্থা করেন। ২০১১ সালে তিনি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনার জন্য ঢাকায় ফিরে যান। সেখানে তিনি ভাষণে বলেন, “আমি দুর্ভাগ্যবশত যুদ্ধের একজন সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী। যদিও আমি কোনও নিরীহ মানুষকে হত্যা করিনি কিংবা হত্যা করার নির্দেশও দেইনি। তবুও আমরা সকলেই অপরাধের ভাগীদার।”
তার ভাষণ শেষে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, “এখন, একজন পাঞ্জাবি কবি ও লেখক হিসেবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ১৯৭১ সালে যারা এত ভয়ংকর কষ্টের শিকার হয়েছিলেন তাদের সবার কাছেই আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
পাকিস্তানের কিছু লেখক, বুদ্ধিজীবী, কর্মী বছরের পর বছর ধরে সেনা অভিযানের নিন্দা করে আসছে। যদিও এ সংখ্যা নগণ্য, তবে দাদার এ ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে তিনি ঐ অল্প সংখ্যক মানুষদেরই প্রতিনিধত্ব করছিলেন। হাবিব জালিব এবং আহমেদ সেলিমের মতো প্রগতিশীল কবি, তাহিরা মাজহার আলী এবং আই.এ. রহমানের মতো কর্মী এবং ওয়ারিস মীরের মতো সাংবাদিকেরা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তাদেরকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। নৃশংসতা ও সহিংসতাকে নীরব হয়ে তারা মেনে নেননি। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল, প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ.এম. ইয়াহিয়া খানের কাছে খোলা চিঠিতে মালিক গোলাম জিলানী শাসকগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে লিখেছিলেন, “আমি সাহসী নই। ভ্রাতৃহত্যায় কে সাহসী হতে পারে?”
এই ভিন্নমতের মানুষেরা- নীরবতার বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠা করে, চুপ থাকার পরিবর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়, শাসকের বর্বরতার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা করে। সেই সাথে তারা পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের ভিত্তির একটি নির্দিষ্ট সমালোচনার ক্ষেত্রও তৈরি করে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্ক সমগ্র বিষয়কে দুইভাবে ব্যাখ্যা করে। এখানকার (পাকিস্তানের) সমস্ত ইতিহাস বইতে স্বাধীনতাকে বিজয় এবং ১৯৭১ সালকে বিশ্বাসঘাতকতার বছর বলে ব্যাখ্যা করা হয়। যদিও সমগ্র বিষয়টিকে অন্য ধারায় দেখার মানুষও রয়েছে, যাদের কাছে স্বাধীনতাটাই ত্রুটিপূর্ণ ছিল, তাই এর ব্যর্থতা অনিবার্যই ছিল। যদিও প্রথম ঘটনাটি জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য দেখায় এবং পরবর্তী ঘটনা যুদ্ধ, বিগ্রহের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের কারণ দর্শায়। তবে যেভাবেই হোক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাফল্য পাকিস্তানের অন্তর্নিহিত ঘাটতিকেই প্রকাশ করে। তখন অবশ্য মনে প্রশ্ন জাগেঃ বাঙালির স্বাধীনতা কি পাকিস্তান ধারণায় অন্তর্নিহিত ছিল? কিংবা পাকিস্তানের ভাগ হওয়া কি অনিবার্য ছিল?
যুদ্ধ শুরুর আগে আমার দাদা, ৪ বছরের জন্য (১৯৬২-৬৬ সাল পর্যন্ত) ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। সে সময়টাকে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় বলতেন। তিনি তখন তার বাঙালি বন্ধুদের সাথে মিশে রসিকতা করতেন। তিনি তার বন্ধুদের জেনারেল সম্বোধন করে রসিকতা করে বলতেন- যদি পূর্ব পাকিস্তান নিজের পথে হাঁটতে শুরু করে, তবে তারা পদমর্যাদায় উপরে উঠে যাবে। তিনি বাঙালিদের প্রকৃত বন্ধুত্বের কথা মনে রেখেছিলেন, সেই সাথে মনে রেখেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্যের মনোভাবকেও। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে আসীন ছিল, যেখানে বাঙালিদেরকে নিম্নপদ দেওয়া হতো। বাঙালিরা নিজেদের সাথে বাংলায় কথা বলতো, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে তাদের ইংরেজিতে কথা বলতে হতো। অফিসারদের জন্য বাংলা ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একবার দাদা সে ক্লাসে যান এবং তাকে বাংলা ক্রিয়াপদের একটি তালিকা দেওয়া হয়। দাদা অবাক হয়ে দেখলেন যে বাংলা এ ক্রিয়াপদগুলোর সাথে পাঞ্জাবির অনেক মিল রয়েছে। এ মিল দেখেই তিনি ভেবেছিলেন বাংলা শেখা তার জন্য কঠিন হবে না।
যদিও দাদা বাঙালি সংস্কৃতিকে ভালোবাসতেন, তবে দাদার কখনো আর বাংলা শেখা হয়নি। একবার এক মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে তিনি রবীন্দ্রসংগীত শুনেছিলেন, যদিও সেসময় সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ছিল। দাদা আমাকে একবার বলেছিলেন, “আমি মনেপ্রাণে একজন বাঙালিপন্থী, একজন পূর্ব পাকিস্তানপন্থী ছিলাম। এতদূর থেকেও আমি আজও বাঙালি সঙ্গীত, ভাষা এবং বাঙালি বন্ধুদের সাথে আমার কাটানো সেই মুহূর্তগুলোকেই বারবার মনে করি।”
দাদা প্রায়ই তার স্মৃতি বিভ্রমের দিনগুলোর কথা মনে করে বলতেন, “আমি প্রায়ই ভাবতাম পাকিস্তান ও ভারত এক হতে চলেছে। আমি একটি গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখতাম।”
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ যখন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে আসেন তখন তার সেই পরিচিত বন্ধুদেরকে অপরিচিত হতে দেখে তিনি তার জনপ্রিয় পঙক্তি রচনা করেন,
“আমরা এখন আবার অপরিচিত,
যারা একসময় বন্ধু ছিলাম
আর কতবার দেখা হলে আমরা আবার বন্ধু হতে পারব?
কবে আমাদের হৃদয়ে আবার প্রেমের সঞ্চার হবে?
এ রক্তের দাগ ধুয়ে যেতে আর কত বর্ষণের প্রয়োজন হবে?”
পাকিস্তানের কাছে অবশ্য ১৯৭১ সাল কোনো সহিংসতা বা বর্বরতার ইতিহাস নয়, বরং সবকিছু হারিয়ে ফেলার ইতিহাস।
সূত্র: মেহের আলী, “বাংলাদেশঃ রাইটিংস অন ১৯৭১, অ্যাক্রস বর্ডারস”, দ্য প্রিন্ট
আইকেজে/