ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রশমনের কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এ আগ্রাসন ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যকার তর্কের কারণ হয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাসে, বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানেই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করকে ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করতে হয়েছে। তবুও এ যুদ্ধ নিয়ে তিনটি সুনির্দিষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে ভারতকে।
প্রথমত, নৈতিকতার প্রশ্নে ভারতকে সমালোচিত হতে হয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে, যে দেশ সারাবিশ্বকে অহিংস নীতি সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করে, সেই দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ব্যাপারে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না জানিয়ে যুদ্ধ ও মানবিক দুর্ভোগকে নৈতিকভাবে সমর্থন জানালো কিভাবে?
দ্বিতীয়ত, ভারতকে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, উদার গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আদর্শিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আদর্শিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এখানে মূল যুক্তি হলো, ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া উদার আন্তজার্তিক ব্যবস্থার জন্য ১৯৪৫ সাল পরবর্তী ঐকমত্যকে লঙ্ঘন করেছে।
পশ্চিমাদের মতে, এই উদার আন্তজার্তিক ব্যবস্থার আবার তিনটি মূল উপাদান রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম উপাদান হলো, ব্যতিক্রম পরিস্থিতি ছাড়া (ব্যতিক্রম পরিস্থিতিগুলো জাতিসংঘের সনদে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে) রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের অলঙ্ঘনযোগ্যতা।
দ্বিতীয়টি হলো, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে যেকোন মূল্যেই রক্ষা করতে হবে, বিশেষত অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে এর রক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যে উদারতাবাদ হলো আদর্শের সর্বোত্তম রূপ এবং মানবাধিকার ও উন্নয়নের সর্বোত্তম রক্ষক।
এক্ষেত্রে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংহতি যৌথ নিরাপত্তা প্রদান করে একটি নিরাপত্তা সম্প্রদায় সৃষ্টি করে।
তৃতীয় উপাদান হলো, উদার আন্তজার্তিক শৃঙ্খলা রক্ষা, একত্রীকরণ এবং প্রসারিতকরণের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান প্রভৃতি দেশগুলোর মতো সংকীর্ণচেতা দেশগুলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে।
ভারত একটি উদারপন্থী এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও ইউক্রেনে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করার জন্য ভারতকে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে।
অবশেষে, ভারতকে নিজেদের স্বার্থরক্ষা এবং বৈশ্বিক চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বেশ কিছু পশ্চিমা রাজনীতিবিদ এবং বিশ্লেষক সম্প্রতি যুক্তি দিয়েছেন যে, ভারতের নিজস্ব সুবিধার জন্যেই রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে রাশিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিত। কেউ কেউ বলেছেন, ভারতের উচিত সস্তা রাশিয়ান তেল কেনা বন্ধ করা। যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর আরো চাপ প্রয়োগ করে এই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বন্ধ করতে পারে।
ভারত যদি পশ্চিমাদের কথামতো চলে তবে পশ্চিমা বিশ্ব ভারতকে সর্বাধুনিক অস্ত্র প্রদানের প্রতিজ্ঞাও করেছে, যেগুলো ভারতীয় সেনাবাহিনী চীন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে। উপরন্তু, চীন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে সাহায্য করার ইঙ্গিতও প্রদান করা হয়।
এই তিনটি প্রধান সমালোচনার প্রতি ভারতও তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে।
প্রথমত, যুদ্ধের নৈতিকতা সম্পর্কে ভারত সবসময় বলেছে যে তারা সব ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং ইএএম জয়শঙ্কর বারবার বলেছেন যে, তারা ইউক্রেনের অচলাবস্থার কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাপ্তি দেখতে চান। সাম্প্রতিক তাসখন্দে এসসিও শীর্ষ সম্মেলন এবং বালিতে জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বিশ্বব্যাপী মানুষদের কাছে এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে, ভারত বিশ্বাস করে এ সময় যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত সময় নয়। ঐতিহাসিকভাবেই ভারত সবসময় প্রতিরক্ষামূলক কূটনীতি প্রদর্শন করেছে। এদেশ কখনো অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি কিংবা কখনো কারো বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক আচরণ করেনি। তাই নৈতিকভাবে, ভারত দাবি করতেই পারে যে রাশিয়ার প্রতি সামনাসামনি প্রতিবাদ না করার মানে এই নয় যে তারা ইউক্রেনের প্রতি অন্যায়কে সমর্থন জানাচ্ছে।
সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের প্রশ্নে ভারত সবসময় বলেছে যে এটি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে এবং যেকোন দেশেরই সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ব্যাপারে সমালোচনা করা উচিত। এক্ষেত্রে পশ্চিমারা যদি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের দায়ে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে, তবে তাদের উচিত ভারতের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের চেষ্টার দায়ে চীন ও পাকিস্তানকে সমালোচনা করা, আফগানিস্তান ও ইরাকের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের দায়ে আমেরিকা ও ব্রিটেনকে অভিযুক্ত করা। পশ্চিমারা নিজেরা একচোখা নীতি অনুসরণ করে ভারতকে নিয়ে সমালোচনা করতে পারে না। তারা রাশিয়া-ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হলেও অন্যসব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকে। এমনকি তারা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনেকসময় অনেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।
গণতন্ত্র রক্ষার ব্যাপারে ভারত তিনটি কথা বলেছে। এক, পশ্চিমাদের নির্ধারিত ইউক্রেনের পক্ষের শক্তি গণতান্ত্রিক এবং বাকিরা কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করে, এ ধারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। পশ্চিমারা সমগ্র বিষয়টিকে এমনভাবে দাঁড় করিয়েছে যার অর্থ দাঁড়ায় হয় তোমরা আমাদের পক্ষে থাকবে নয়ত বিপক্ষে। কিন্তু ভারত এ যুদ্ধকে এমন দৃষ্টিতে দেখছে না। জয়শঙ্কর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে বলেন, ভারত এই পুরো ঘটনাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে এবং সমাধানের চেষ্টা করবে নিজের মত করে। দুই, যেহেতু ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ, তার মানে এই দাঁড়ায় না যে ভারত অন্ধের মতো আরেকটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি সমর্থন দিবে। বন্ধু তাকেই বলে যে বন্ধুর প্রশংসা নয় বরং নিন্দা করার অধিকারও রাখে। হতে পারে, ইউক্রেনে পশ্চিমাদের কার্যক্রম রাশিয়াকে এতটা উত্তেজিত করেছিল যে রাশিয়া এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। তিন, ভারত কখনোই বিশ্বকে উদারপন্থী কিংবা সংকীর্ণচেতা হিসেবে বিভক্ত করে নি। বিশ্বকে সে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা ইত্যাদি ভৌগোলিক ভাগেও ভাগ করে না। তাই এসব নিয়ে আলোচনা পশ্চিমাদের জন্য এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে।
তাছাড়া ভারতের যুক্তি হলো কোন দেশকে ভৌগোলিকভাবে সরানোর ক্ষমতা কারোরই নেই। তাই রাশিয়া ভূ-কৌশলগতভাবে ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, রাশিয়া হলো ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সমান ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। চীনের সাথে ভারতের কিছু সীমানা নিয়ে বিবাদ বিদ্যমান, তেমনিভাবে রাশিয়ার সাথেও চীনের সীমান্ত নিয়ে বিবাদ আছে। তাই বিতর্কিত সীমান্তে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে রাশিয়া ভারতকেই সহযোগিতা করবে এ সম্ভাবনাই প্রবল। মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের মাধ্যমে, রাশিয়া কৌশলগতভাবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকেও বেষ্টনী দিতে পারে, যা ভারতের জন্য সুবিধার হবে।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়া কূটনৈতিকগতভাবে অনেক নির্ভরযোগ্য অংশীদার। রাশিয়া সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারতকে সহযোগিতা করেছে, যেমন কাশ্মির বিতর্কে রাশিয়া ভারতের পাশে ছিল। ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশ-ভারত যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল তখন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সমর্থনে থাকলেও রাশিয়া তখনও ভারতকে সাহায্য করে। যে দেশ নিজের ইতিহাস ভুলে যায়, তারা অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, আর তাই বিগত সাত দশকে পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের সমর্থন ভারত কখনোই ভুলবে না।
রাশিয়ার সাথে ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত হওয়া নিয়ে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। ভারত জাতীয় স্বার্থেই রাশিয়া থেকে কম দামে তেল ক্রয় করছে। রাশিয়ানরা যৌথ উদ্যোগ স্থাপন, সর্বশেষ প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং ভারতীয় মুদ্রায় অর্থপ্রদান গ্রহণের জন্যেও অনেক বেশি উন্মুক্ত।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভারতকে দেখতে পাচ্ছি যে দেশ পশ্চিমাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে নারাজ।