ডেস্ক রিপোর্ট, সুখবর ডটকম: ভারতের উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ। এই অরুণাচল প্রদেশের সাথে তিব্বতের সীমান্ত সম্পর্ক রয়েছে। আবার এই অরুণাচল প্রদেশই গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (পিআরসি) দ্বারা দাবিকৃত বৃহত্তম অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। এ অঞ্চলের সীমানার মালিকানা নিয়ে ভারতের সাথে চীনের দ্বিমত থাকায় এখানে আইনত এক সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়, যার নাম ম্যাকমোহন লাইন।
তবে ম্যাকমোহন লাইনকে মেনে নিতে অস্বীকার জানায় চীন। চীনের কাছে এ লাইন অবৈধ এবং অগ্রহণযোগ্য। একে অবৈধ বলার পেছনে তারা কিছু কারণ দেখায়। যার মধ্যে প্রথম কারণ হলো, চীন-ভারত সীমানা কখনো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয় নি। চীনের কেন্দ্রীয় সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে কোন ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় নি। দ্বিতীয় কারণ, বেইজিং সাম্রাজ্যবাদী উত্তরাধিকারে বিশ্বাসী। এই অজুহাতে তারা ম্যাকমোহন লাইনকে প্রত্যাখান করে এবং ব্রিটেন, চীন ও তিব্বতের মধ্যে ১৯১৪ সালের সিমলা কনভেনশনকে উপেক্ষা করে। তাদের মতে, তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র না হওয়ায় চুক্তিতে অংশীদারত্বের অধিকার তিব্বতের নেই। তাই চীন-ভারত সীমান্তে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন সীমারেখার অভাব, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল নিয়ে চুক্তির অভাবের মতো বিভিন্ন কারণে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমানাবিরোধ এখনো চলছে। এর ফলে, ভারত-চীন সীমান্ত তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেঃ পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল। অরুণাচল প্রদেশ এই পূর্বাঞ্চলেরই একটি অংশ।
বছরের পর বছর ধরে, অরুণাচল প্রদেশের উপর চীনের দাবি বেড়েই চলেছে। প্রথমদিকে চীন কেবলমাত্র তাওয়াং অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করেছিল। কিন্তু ১৯৮০ এর দশক থেকে চীন সমগ্র অরুণাচল প্রদেশকে তার দক্ষিণ তিব্বত অঞ্চলের অংশ হিসেবে দাবি করতে থাকে। এ বিষয়ে ২০০৬ সালে, চীনা রাষ্ট্রদূত সান ইউক্সি ভারতে বলেন যে, “সমগ্র অরুণাচল প্রদেশই আমাদের। তাওয়াং তার একটি অংশ মাত্র।” তবে মজার ব্যাপার এই যে ১৯৬০ সালে বেইজিং ঠিকই তখন ম্যাকমোহন লাইনকে মেনে নিয়েছিল। আবার ১৯৬০ সালে চীন এভারেস্ট পর্বতকে জলাধার নীতি অনুযায়ী বিভক্ত করে নেপালের সাথে সীমানা নির্ধারণ করে। কিন্তু ঐ একই জলাধার নীতি অনুসরণকারী ম্যাকমোহন লাইনকে এখন তারা মানতে নারাজ। এখানেই চীনের পক্ষপাতমূলক আচরণের প্রকাশ পায়। তাছাড়া এলএসি বরাবর সীমানা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে চীন বারবার অরুণাচল প্রদেশকে নিজের দখলে নিতে চেয়েছে।
চীনা সরকারি মানচিত্রে অরুণাচল প্রদেশের বেশকিছু অংশের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, চীনের বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়, ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ১৫টি স্থানের নাম পরিবর্তন করে, যার মধ্যে রয়েছে ৮টি আবাসিক বসতি, ৪টি পাহাড়, ২টি নদী এবং একটি পর্বত গিরিপথ। ২০১৭ সালেও চীন অরুণাচল প্রদেশের ৬ টি অংশের নাম পরিবর্তন করে। চীন এই কৌশল ব্যবহার করে অরুণাচল প্রদেশের উপর নিজের দখলদারিত্বকে শক্তিশালী ও বৈধ করতে চাইছে। এ কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ভারত জানায়, “অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অংশ ছিল এবং থাকবে। গুটিকয়েক অংশের নাম পরিবর্তন করে এ সত্যকে পরিবর্তন করা যাবে না।” তবে ১জানুয়ারি, ২০২২-এ একটি নতুন সীমান্ত আইন বাস্তবায়ন হয়, যা চীনা মানচিত্রে নতুন নামকরণকে বৈধতা প্রদান করে।
আবার বেইজিং ভারতীয় নেতা এবং দালাইলামার অরুণাচল প্রদেশে সফর নিয়ে বিরোধিতা করে। বেইজিং প্রধানত তিনটি কারণে এই বিরোধিতা করে। প্রথমত, চীন-ভারত সীমান্তের পূর্বাঞ্চলে চীনের অবস্থান সুসংগঠিত এবং স্পষ্ট। দ্বিতীয়ত, চীনা সরকার অরুণাচল প্রদেশকে কখনোই স্বীকৃতি দেয় নি। তৃতীয়ত, সীমান্ত জটিলতাকে আরো জটিল করে তুলে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে ভারতের বিরত থাকা উচিত। ২০২১ সালের অক্টোবরে উপরাষ্ট্রপতি এম. ভেঙ্কাইয়া নাইড়ু অরুণাচল সফরে গেলে চীন বরাবরের মতো এর বিরোধিতা করে। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজ্যের ব্যাপারে চীনের নাক গলানো অবৈধ এবং অযৌক্তিক।
এছাড়াও অরুণাচল প্রদেশের উচ্চ সুবানসিরি জেলা বরাবর “জিয়াওকাং” গ্রাম তৈরি করেছে চীন। ২০২১ সালে, মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে চীন এলএসি এর পূর্ব অংশে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের ভেতর ১০০ ঘরবিশিষ্ট এক বেসামরিক গ্রাম নির্মাণ করেছে। ২০১৭ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনা অঞ্চল রক্ষার জন্য এবং অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের আয়ত্বে আনার জন্য সীমান্ত প্রদেশে নিজেদের অধিকার বজায় রাখার কথা বলেছিলেন। সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন গ্রাম নির্মাণের মতো কাজ করেছে চীন।
চীন অরুণাচল প্রদেশকে পাওয়ার লোভে এতোটাই মগ্ন যে তারা বুঝতেই পারছে না সত্যিটা। প্রকৃতপক্ষে এটাই সত্য যে ভারত আইনগতভাবে এ অঞ্চলটি পরিচালনা করছে যেখানে চীন আইনের বাইরে গিয়ে এ অঞ্চলকে দাবি করছে। চীনের বুঝা উচিত যে অরুণাচল প্রদেশ ভারতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আইকেজে /