ইব্রাহীম খলিল জুয়েল: বাংলাদেশের ‘ফুসফুস’ খ্যাত ম্যানগ্রোভ বন ‘সুন্দরবন’ প্রতিবারই দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বুক চিতিয়ে লড়াই করে রক্ষা করে আমাদেরকে। কমে যায় প্রাণহানি এবং সম্পদহানি। অথচ, ঝড় চলে যাওয়ার পর মানুষ আবারও নেমে পড়ে সুন্দরবন ধ্বংসে।
পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের একটি হিসেবে গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত সুন্দরবন সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ এবং ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি (৬২%) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। অথচ, এই সুন্দরবনকেই ধ্বংস করা হচ্ছে প্রতিদিন। কাঠ পাচারকারীরা উজার করছে বন। এই বনেই বিষ দিয়ে মাছ মারছে এক শ্রেণির মানুষ। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র। সুন্দরবন বাংলাদেশের ‘রক্ষাকবচ’ হয়েই প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজের বুক পেতে দেয়। বাঁচায় দেশের কোটি মানুষকে। এ পর্যন্ত উপকূলে ঘূর্ণিঝড়সহ যেসব প্রকৃতিক দুর্যোগ দেখা গেছে, তার অধিকাংশই ঠেকিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন।
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র আঘাত থেকেও উপকূলবর্তী অঞ্চলকে রক্ষা করে সুন্দরবন। সুন্দরবন না থাকলে সাগর থেকে উৎপন্ন দুর্যোগ বাংলাদেশকে ধুয়ে নিয়ে যেতে কোনো দ্বিধা করত না বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
তবে সুন্দরবন ধ্বংসে নানা অপকর্ম থেমে নেই। বিপন্ন হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র। এর মধ্যে সুন্দরবন রক্ষায় আওয়াজ উঠেছে দেশ তথা বিশ্বজুড়ে।
দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭) বিশ্বের একমাত্র বৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনকে বিভক্ত করা হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। যার একাংশ ভারতের এবং অধিকাংশই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অংশে। দুই দেশের মধ্যে ভাগ হলেও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র ও বাস্তুসংস্থান ভিন্ন নয়।
একক বাস্তুসংস্থান হওয়ায় এর জন্য দুই দেশের যৌথ প্রকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন বলেই মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি সংস্থাটির ‘ল্যান্ডস্কেপ ন্যারেটিভ অব দ্য সুন্দরবন’শীর্ষক প্রতিবেদনে এমনটিই বলা হয়েছে।
সুন্দরবনকে না বাঁচালে গোটা দক্ষিণাঞ্চল একটা দ্বীপে পরিণত হবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। আবহাওয়াবিদরা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বনাঞ্চলের ওপর দিয়ে দুই ধরনের ধাক্কা যায়। প্রথমে ক্ষিপ্র গতির বাতাস, এরপর জলোচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাস লোকালয়ে পৌঁছানোর আগে সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এর ঢেউয়ের উচ্চতা অনেক কমে যায়। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস বাধাপ্রাপ্ত হয়ে গতি কমে যায়। পরে সেটা শক্তি হারিয়ে দমকা বাতাসে রূপ নেয় বলে জানান আবহাওয়াবিদরা।
২০০৭ ও ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা এবং সর্বশেষ বুলবুল’কে এভাবেই থামিয়ে দেয় সুন্দরবন। অন্যদিকে একই ঘূর্ণিঝড় যদি বরিশাল কেন্দ্রিক হতো তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা বড় দুর্যোগ বয়ে আনতো বলে আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
খুলনা বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. বশিরুল আল মামুন জানান, এবারের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্য প্রাণীর ওপর বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। বুলবুল’র আঘাতের সময় সুন্দরবনে জোয়ার থাকায় বেশি উচ্চতা নিয়ে পানি আঘাত করতে পারেনি।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশমিক ১ শতাংশের জীবিকা এ বনের ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের আয়তন হওয়ার কথা ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কিলোমিটার। দুইশ’ বছর আগের হিসেবে এমনটি দেখানো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এর আয়তন হয়েছে পূর্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়াও কাঠ, জ্বালানী ও মন্ডের মতো প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার গোলপাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের এই ভূমি একই সাথে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা’র ১৯৯৫ সালের এক জরিপে বলা হয়, এই বন প্রচুর প্রতিরোধমূলক ও উৎপাদনমূলক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশ জুড়ে সুন্দরবন, বন থেকে আসা মোট আয়ে অবদান প্রায় ৪১ শতাংশ এবং কাঠ ও জ্বালানী উৎপাদনে অবদান প্রায় ৪৫ শতাংশ।
সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে অনুমোদিত ১৯০টি ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে ২৪টি প্রকল্প মারাত্মক দূষণকারী ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত দূরত্বের চেয়ে পরিবেশের জন্য ঝুঁকির বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘কতো কিলোমিটারের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান, এগুলো আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোন প্রতিষ্ঠানের দ্বারা কতটা ক্ষতি হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ কিলোমিটার দূরের কোনও কারখানাও মারাত্মক দূষণকারী হতে পারে।’
সুন্দরবন রক্ষায় দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন এমন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ যেটা ধ্বংস হলে আর আমরা তৈরি করতে পারব না।’
এদিকে, সুন্দরবনকে রক্ষায় শীঘ্রই ২২টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রণয়নের কথা জানিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মোঃ এনামুর রহমান। বনে যত্রতত্র গাছ কাটা ঠেকাতে ও জীববৈচিত্র রক্ষায় বনের নিরাপত্তা বাড়ানো, সেইসঙ্গে বনায়নের জন্য বেশি বেশি গাছ লাগানোর সুপারিশ করবেন তারা। বর্তমান সুন্দরবন অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকারই গঠন হয়েছে গত পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে বলে জানা যায়।
১৯৮৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বনভূমিটি স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।
জরিপ মোতাবেক, বর্তমানে সুন্দরবন এলাকায় ১০৬ বাঘ ও ১,০০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন ‘রামসার স্থান’হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। তাই সুন্দরবনকে আমাদের অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।